ডেস্ক রিপোর্ট
৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ
আবু নাসের অনীক:
এই লেখাটির মাধ্যমে আপনাদেরকে আমি একটু পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাস। তৎকালীন বিএনপি সরকার সাধারণ নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ তখন রাজপথে তুমুল আন্দোলনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে।
হরতাল, অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ তখন বিপর্যস্ত। তার পূর্বেই ১৯৯৫ সালের পুরো বছরজুড়ে হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফ্রেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে থাকে, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে সড়ক, নৌ এবং রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি লাগাতার হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ।
এমন অবস্থায় সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য জোর চেষ্টা করেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেন। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতরা বৈঠকে অংশ নেন। কিন্তু তারা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হন।
এই সবকিছুর মধ্যেই ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫০ আসনে নির্বাচন হয় এবং ৪৬ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিএনপি প্রার্থীরা জয়ি হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহবান জানান এই সরকারকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য। যা আজকে বিএনপি বলছে!
আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেনাবাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ১৭২ দিন হরতাল করেছিলো। এবং সেটি ছিলো সহিংস। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর দাবী মানতে বিএনপিকে বাধ্য করে আওয়ামী লীগ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে জাতীয় সংসদের তিনশো’ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ি হয়েছিল,যেজন্য বাংলাদেশের মোট ৯,১৯,৬৫,৯৭৭ ভোটারের মধ্যে কাগজে-কলমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো ৪,৩৯,৩৮,৯৩৮ জন। প্রকৃত অর্থে এই নির্বাচনটির সাথে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের বিশেষ কোন পার্থক্য ছিলোনা।
উপরে অতীতের এই বিষয়গুলি সামনে আনা হলো এজন্যই যে, আজকে দেশে যে রাজনৈতিক ঘটনাবলী সংঘটিত হচ্ছে সেগুলি বর্তমান সরকারী দলের পক্ষ থেকেওে ১৯৯৬ সালে সংঘটিত হয়েছিলো। গত ২৮ তারিখে বিএনপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এরমধ্যে একজন পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনাও আছে। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের হামলায় সে নিহত হয়েছে। তারা ভুলে গেছে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া রাজশাহীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানে তার সমাবেশের কাছেই বোমা হামলায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। তাহলে কী দাঁড়ালো? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় রাজনৈতিক দলই পুলিশ হত্যায় সম্পৃক্ত!
সেদিন খালেদা জিয়া যে ভাষায় কথা বলেছিলেন,একেবারেই অভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যারা যখন সরকারে থাকেন তখন তাদের কাছে বিরোধী দলের আন্দোলনের কোন ন্যায্যতা থাকেনা। উপরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী সেটিই প্রমাণ করে।
আজকের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি বিরোধী দলের আন্দোলনকে সহিংসতা হিসাবে চিহ্নিত করছে। অথচ তারা ভুলে গেছে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তাদের ভূমিকার কথা।
সেইসময় তিন দিনের তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কার্যত রাজপথ দখলে নেয়।বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই তিনদিনের সংঘাতে দেশে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়। এর অধিকাংশই ছিলো সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া বিএনপি-জামাতের কর্মী।
আজকের আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই কার্যত অহিংস আন্দোলন করেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেকোন দাবী আদায়ের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ একটি অপরিহার্য উপাদান হিসাবে সবসময় কাজ করেছে। আর বল প্রয়োগ হলে সহিংস ঘটনা ঘটবে এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে আন্দোলন হচ্ছে, সহিংস ঘটনা ঘটছে এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের গণমানুষের অধিকার কতোটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সেটি বিবেচনায় নিলে আমরা দেখবো বাংলাদেশের ৫৩ বছরে এখনও পর্যন্ত সেটি অধরাই থেকে গেছে।
গত ২৮ তারিখের কর্মসূচিকে কেন্দ্রকরে পুলিশের একজন সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ব্যক্ত করাটাই স্বাভাবিক। ঠিক তার দুইদিন পর ৩০ অক্টোবর গাজীপুরে বাসন এলাকায় বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। সেইসময় রাসেল নামে একজন শ্রমিক নিহত হয় পুলিশের গুলিতে।
একটু ভাবুন; শ্রমিকরা আন্দোলন করছে বেতন বৃদ্ধির দাবীতে। আর সেই আন্দোলন দমন করার জন্য রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী গুলি করে শ্রমিক হত্যা করছে। অথচ এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বক্তব্য প্রদান করা হয়নি। অথচ তার দুদিন আগে যখন পুলিশ নিহত হলো তখন সমগ্র রাষ্ট্র তৎপর হয়ে উঠলো।
পুলিশ এবং শ্রমিক দুইটা হত্যাকান্ডই নিন্দাযোগ্য। কিন্তু পুলিশ হত্যায় প্রতিক্রিয়া দেখাতে রাষ্ট্র যতোটা তৎপর শ্রমিক হত্যায় ঠিক ততোটাই নির্বিকার। অর্থাত এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শ্রমিক হত্যা জায়েজ আছে এমনটাই বোঝায়।
গত ৫৩ বছরে সহিংসতার মধ্যে দিয়ে এখানে নানা সময় লুটেরা রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে শুধুমাত্র। তাদের দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুটপাটের হাত বদল ঘটেছে মাত্র! কিন্তু গণমানুষের ভাগ্যের মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
এখানে ক্ষমতা পালাবদলের জন্য সহিংস আন্দোলন করতে হয় একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকবার পরেও। কারণ যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায় এরা প্রত্যেকেই লুটেরা শ্রেনির। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা। তার জন্যই এদের তত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়।
যখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তখন তারা সেটিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নেয়। ক্ষমতাতন্ত্র-লুটপাটতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
যে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, সেই সরকারের প্রকৃতঅর্থে এই ব্যবস্থা বাতিল করার কোন নৈতিক অধিকার থাকে না। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই অনৈতিক কাজটি করেছে। তাদের এধরণের পরিকল্পনা থাকলে সেটি আগেই নির্বাচনী ইস্তেহারে তারা উল্লেখ করতে পারতো।
এটি একটি মৌলিক বিষয় ছিলো বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের বর্তমান এই সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। একদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের অসহনীয় পরিস্থিতি; অন্যদিকে লুটপাটের কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য জনগণের জীবন দূর্বিসহ করে তোলার কোন অধিকার শাসকগোষ্ঠীর নাই।
এর বিপরিতে জনগণের শক্তিকেই সংগঠিত হতে হবে। বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন এর লড়াই-সংগ্রাম সংঘটিত করার বিকল্প কিছু নেই। এটাও নিশ্চিত সেই লড়াইটিও অহিংস পথে ঘটবে এমনটি নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই যদি সহিংস পথে হয় সেটির নিশ্চয়ই ন্যায্যতা রয়েছে।