ডেস্ক রিপোর্ট

২১ মার্চ ২০২৩, ৭:০৯ অপরাহ্ণ

আরাভকাণ্ড: যে প্রলোভনে পড়ে ‘রবিউল’ হয়ে জেলে গিয়েছিলেন ইউসুফ

আপডেট টাইম : মার্চ ২১, ২০২৩ ৭:০৯ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

অধিকার ডেস্ক: পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের পরিচয় ধারণ করে কারাগারে ঢুকেছিলেন চাঁদপুরের যুবক আবু ইউসুফ ওরফে লিমন। প্রায় ৯ মাস জেল খেটে প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে তিনি কারামুক্ত হন। ইউসুফের ভাষ্য, তিনি প্রলোভনে পড়ে রবিউল হয়ে জেলে গিয়েছিলেন।

রবিউল কী প্রলোভন দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে জানতে গতকাল সোমবার রাতে ইউসুফের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দাবি করেন, তাঁকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিয়েছিলেন রবিউল। তিনি প্রলোভনে পড়ে রবিউল হয়ে জেলে ঢুকে যান। কথা ছিল দেড় মাসের মধ্যে তাঁকে জামিনে মুক্ত করবেন রবিউল। কিন্তু তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। একপর্যায়ে তিনি বিষয়টি তাঁর পরিবারকে জানান। তাঁর বাবা আইনজীবী ধরে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন।

ইউসুফের (২৩) বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আইনপুর গ্রামে। তাঁর বাবা মো. নুরুজ্জামান। তিনি চাঁদপুরের একটি সরকারি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ইউসুফ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পরে তাঁর আর পড়ালেখা করা হয়নি বলে জানান তিনি। ইউসুফ এখন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

ঘটনার বিষয়ে জানতে গতকাল রাতে ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামানের সঙ্গেও মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁর ভাষ্য, ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ইউসুফ। পরে তাঁর কোথাও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ছেলের খোঁজ না পেয়ে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন নুরুজ্জামান। একপর্যায়ে পরিবার জানতে পারে, ইউসুফ কারাগারে। এই খবর পেয়ে নুরুজ্জামান চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসেন।

আইনজীবী ধরে আদালতের মাধ্যমে ছেলেকে কারাগার থেকে বের করেন। এই মামলা থেকে ইউসুফ রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু পরিচয় গোপন করে কারাগারে যাওয়ার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। এই মামলায় ইউসুফ এখন জামিনে আছেন।

এসবির পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে খুন হন। পরদিন গাজীপুরের জঙ্গল থেকে তাঁর আধপোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে রবিউলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মামুন হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান রবিউল ইসলাম। সেখানে তিনি বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। পাসপোর্টে নাম দেওয়া হয় আরাভ খান। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। গত বুধবার রাতে দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধন করতে যান বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান, চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাসসহ কয়েকজন তারকা। গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য, আরাভ খান পুলিশ হত্যা মামলার পলাতক আসামি, এ তথ্য তারকাদের জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাঁরা সেখানে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মামুন হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান রবিউল। সেখানে তিনি বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। পাসপোর্টে তাঁর নাম দেওয়া হয় আরাভ খান। এই পাসপোর্ট দিয়েই তিনি পাড়ি জমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। তিনি এখন দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। গত সপ্তাহে দুবাইয়ে তাঁর মালিকানাধীন আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন হয়। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে আলোচনায় আসেন রবিউল।

মামুন খুনের মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, ১০ আসামির মধ্যে রবিউল শুরু থেকেই পলাতক। বাকি আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মামলাটি এখন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।

মামলায় ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর রবিউলের পরিচয় ধারণ করে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন ইউসুফ। সেদিন আদালত তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইউসুফ আদালতের কাছে দাবি করেন, তিনি পুলিশ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি রবিউল নন। তিনি রবিউলের পরিচয় ধারণ করে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

ইউসুফের দাবি সত্য কি না, তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ডিবিকে নির্দেশ দেন আদালত। ডিবি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। ডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যাওয়া ব্যক্তি (ইউসুফ) মামলার প্রকৃত আসামি রবিউল নন। তিনি চাঁদপুরের ইউসুফ। ২০২১ সালের ৩ জুন ইউসুফকে পুলিশ খুনের মামলা থেকে মুক্তির নির্দেশ দেন আদালত।

আদালতের আদেশে বলা হয়, ইউসুফ নিজের পরিচয় গোপন করে ভিন্ন পরিচয় ধারণ করেছেন। এভাবে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। ইউসুফসহ এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন আদালত।

এ ঘটনায় ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে ইউসুফ, রবিউলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় প্রতারণার মামলা করেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন মো. জুবায়ের, জি এম ফরহাদুল ও আইনজীবী সোহেল ফজলে রাব্বি। এই মামলায় কারাগারে যান ইউসুফ। পরে জামিনে মুক্তি পান। মামলায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে বিচারাধীন।

ইউসুফ দাবি করেন, ফেসবুকের মাধ্যমে রবিউলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পরিচয়ের পর রবিউলের সঙ্গে মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর কথা হতো। রবিউল একদিন তাঁকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখান। বিনিময়ে তাঁকে রবিউল হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দেন। ইউসুফ এই প্রলোভনে পা দেন। তিনি রবিউলের কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেননি বলে দাবি করেন।

ইউসুফ বলেন, ‘আমি রবিউলের ফাঁদে পা দিয়ে বড় ভুল করেছি। এখন মামলার ঘানি টানছি।’

ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, ‘রবিউলের ফাঁদে পা দিয়ে আমার ছেলের জীবন নষ্ট হওয়ার পথে। এখন মাসের পর মাস মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এই ঝামেলায় এখন পর্যন্ত আমার প্রায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ঋণ করে এই টাকা সংগ্রহ করেছি। এর ফলে এখন আমার ঋণের বোঝাও বইতে হচ্ছে।’ সূত্র: প্রথম আলো

 

শেয়ার করুন