ডেস্ক রিপোর্ট
১০ জুলাই ২০২৪, ৯:৪২ অপরাহ্ণ
আবু নাসের অনীক :
গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশে দুর্নীতির সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির বিষয়ে ব্যপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে সাবেক সেনা প্রধান, পুলিশ প্রধান, এনবিআর কর্মকর্তা, পিএসসি’র চেয়ারম্যানের ড্রাইভার থেকে শুরু করে অনেকের নামই উচ্চারিত হচ্ছে।
তাদেরকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের ট্রল হচ্ছে। সবাই উচ্চ কন্ঠে এই সমস্ত দূর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের বিচার দাবী করছেন; একইসাথে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের ধর্ম পালন নিয়েও ট্রল করছেন। যেমন সাবেক পুলিশ প্রধানের হজ্জব্রত পালন,পিএসসি’র চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের ধর্ম পালন নিয়ে কতো কথা!
সবারই টার্গেট এর জায়গা ব্যক্তি! সাবেক সেনা প্রধান বা পুলিশ প্রধান যে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বা যেকোন ধরণের অন্যায় সুযোগ গ্রহণ করেছেন এর সবটাই সংঘটিত হয়েছে তাদের পেশাগত জীবনেই। যখন একজন দায়িত্বরত অবস্থাতাতে দুর্নীতির সাথে যুক্ত হন তখন তাদের সম্পর্কে সরকার অবগত থাকেনা এটা খুবই হাস্যকর একটা বিষয়।
একজন সেনা প্রধান বা পুলিশ প্রধান যখন দায়িত্ব পালন করে থাকেন তখন তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্থা যে পর্যবেক্ষণ করে এটাই প্রচলিত আইন কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত থাকে।
এমনকি তারা কাদের সাথে যোগাযোগ করছেন, কাদের সাথে আত্মীয়তা রক্ষা করছেন এই সবকিছুই সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রিপোর্ট থাকে। তাদের প্রতিটা গতিবিধি সরকার এই সমস্ত সংস্থার দ্বারা অবহিত থাকে। সেনা প্রধান বা পুলিশ প্রধানের সকল ধরণের অনিয়ম ও লুটপাটের বিষয়টি সামনে আসে যখন তারা তাদের নিজ দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন তখন! দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তাদের নামে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অভিযোগ উঠলেও সরকার তাদের পক্ষবালম্বন করে তখন।
তারা দায়িত্ব পালনের এক মুহুর্ত পূর্ব পর্যন্ত এই সমস্ত বিষয়ে টুশব্দটি শোনা যায়নি দূর্নীতি দমন কমিশনের কাছ থেকে। যখন এই সমস্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বের বাইরে চলে যান তখন তারা অনেকটাই নখদন্তহীন বাঘের পর্যায়ে পৌছে যান।
তারা ক্ষমতা কাঠামোর মূল কাঠামোর বাইরে চলে যান। এমন একটি সময়ে তাদের সাথে সরকারের যদি কোন ধরণের টানাপোড়েন তৈরি হয় তখন তারা রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে থাকেন। একধরণের বলির পাঠাতে পরিণত হন।
একটি লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সেই লুটেরা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সহায়ক সরকার যখন ব্যপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে থাকে তখন কাউকে না কাউকে “স্কেপ গটে”র স্বীকার হতে হয়। লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই “স্কেপ গট” বানানো হয় সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
তখন ব্যক্তি সে যেই হোক না কেন তাকে বলি দেওয়া হয় ক্ষমতাসীনদের নিজেদের স্বার্থে। সে তার অতীতে কি ভুমিকা রেখেছে এই লুটেরা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তখন তারা সেটি বিস্মৃত হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও ঘটেছে তেমনটিই!
বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রায় সর্বঅঙ্গে ক্ষত তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষতে এখন মলম লাগানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই! বাংলাদেশের বর্তমানে দুর্নীতির বিষয়ে যে অবস্থান সেটা সেই মলম লাগানো। যাতে ক্ষতটা এগজিমায় পরিণত হওয়ার আগেই শুকিয়ে ফেলা যায়! এবং আরো কয়েক বছরের জন্য ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখা যায়!
এটা খুবই হাস্যকর যে একটা ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন সাবেক সেনা প্রধান, পুলিশ প্রধান, এনবিআর এর কর্মকর্তা বা পিএসসি চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের এই ধরণের অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি হয়।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কয়েক বছর আগে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবগুলোকে কেন্দ্র করে জুয়ার মাধ্যমে শতকোটি টাকা লুটপাটের কাহিনী! গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সেকি হুলুস্থুল কান্ডকারখানা! মনে আছে নিশ্চয়ই নায়িকা পরিমনির বোট ক্লাবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হইহই রব!
শোনা গিয়েছিলো সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তারা ফেসে যাবেন এই ঘটনাতে! সামান্য কয়েকজন চুনোপুটি ছাড়া কেউ ফাসেন নাই! আবার সেই চুনোপুটিরাও সময়ের কালক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছেন।
এভাবেই চলতে থাকে! এটাই বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সমস্ত আয়োজন। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কারণ এদের সহযোগিতা ছাড়া সেই সরকারের টিকে থাকার অন্য কোন সুযোগ থাকে না।!
যখন এটা গলার কাটায় পরিণত হয় তখন সে তার বেঁচে থাকার স্বার্থেই সেই গলার কাটাকে উপড়ে ফেলে সমুলে। কিন্তু তার মানে এই না যে সরকার সকল ধরণের অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে।
সাবেক সেনা ও পুলিশ প্রধান সম্পর্কে সরকারী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন,“বেনজীর আহমেদ ও আজিজ আহমেদের অপরাধ ব্যক্তিগত। সে অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি পেতেই হবে।” কি হাস্যকর বক্তব্য!
তারা দুজনেই ছিলেন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বাহিনীর প্রধান! তারা যে সকল অনিয়ম করেছেন তা তাদের দায়িত্ব পালনকালীন সময়েই করেছেন। দায়িত্ব থেকে অবসরের পরে করেন নাই!
মাননীয় নেতা, আপনাদের এত এত গোয়েন্দা সংস্থা তখন সেই অনিয়মগুলো টের পান নাই! তাদের নিয়োগ দিলো সরকার আর তারা দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে এত এত অনিয়ম করলেন আর তার দায় ব্যক্তি আজিজ আর বেনজীরের ঘাড়ে যেয়ে বর্তালো! তাহলে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা আর সরকারের দায় কোথায়!
এত অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন তার দায়িত্ব কার?? একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার এটি একটি আবশ্যক কর্তব্য যে দায়িত্বকালীন সময়ে কেউ অপরাধ সংঘটিত করলে সেটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা! দায়িত্ব ছাড়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণ না।
এমনটি সংঘটিত হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থায়। কারণ সেই সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার সময়ই বিভিন্নভাবে সরকারকে অবৈধ সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। তখন তাদের বিরুদ্ধে যতো ভয়ানক অভিযোগ থাকুক না কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এটাই রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সহজ পাঠ। তার জন্য রকেট সাইন্স বোঝার ব্যপার থাকে না।
যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন তারা ব্যক্তির দিকে যেমন আঙ্গুল তুলছেন একইসাথে এই লুটেরা ব্যবস্থার দিকেও আঙ্গুল তুলেন। শুধুমাত্র ব্যক্তির বিচার চাওয়া মানে এই লুটেরা ব্যবস্থাকে আড়াল করা। একজন আজিজ, বেনজীর, মতিউর রহমান, ফয়সাল বা একজন জাবেদ আলীর বিচার চাইলেই এই অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে না। এদের বিচার হলেও বন্ধ হবে না!
এমন অনেক জাবেদ আলী বা বেনজীর এর জন্ম হবে যদি না ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলা না হয়। বরং তাহলে বিদ্যমান এই ব্যবস্থাপনাকে এটি টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। আসুন আমরা এই লুটেরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।
লেখক: জনস্বাস্থ্যবিদ।