ডেস্ক রিপোর্ট
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১৪ অপরাহ্ণ
রাজেকুজ্জামান রতন:
মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন সবই সৃষ্টি হয় মানুষের শ্রমে। প্রকৃতিতে যা যেভাবে আছে সব কিছু সেভাবেই মানুষ ব্যবহার করে না। তাকে ব্যবহার উপযোগী করে নিতে হয়। ব্যবহার উপযোগী করে নেওয়ার ক্ষেত্রে শারীরিক এবং মেধাগত শ্রম ব্যবহার করেই মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে। সাধারণভাবে তাই বলা যায়, প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষমতা যে সমাজ যত অর্জন করেছে সে সমাজ তত উন্নত, সে সমাজে মানুষের জীবন তত সহজ এবং স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে। কিন্তু এখানেই একটা বৈপরীত্য কাজ করছে। যারা জীবিকার প্রয়োজনে নিজেদের শ্রমশক্তি ব্যবহার করে তাদের বলা হয় শ্রমিক। এসব শ্রমিক, যাদের শ্রমে জীবনযাত্রা সহজ হয়ে উঠে তাদের জীবনযাপন কিন্তু ততটা সহজ হয় না। যেমন কৃষকের শ্রমের ফলে খাদ্য পাওয়া সহজ কিন্তু কৃষকের দুর্দশা কাটে না। পোশাক শ্রমিকের কারণে পোশাক পাওয়া সহজ, পরিবহন শ্রমিকের কারণে যাতায়াত করা সহজ, নির্মাণ শ্রমিকের কারণে বসবাস করা সহজ, প্রকাশনা খাতের শ্রমিকদের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য পাওয়া সহজ। এমনি নানা ক্ষেত্রে শ্রমিকের শ্রম সমাজের সব মানুষের জীবনযাপনকে সহজ ও উন্নত করলেও শ্রমিকরা থাকছে অবহেলিত, তাদের জীবন উন্নতির ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।
সমাজ বিকাশের এই পর্যায়ে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রমশক্তির বিনিময়ে পায় মজুরি। মজুরি দিয়েই সে তার জীবনের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে। সে যেসব পণ্য ব্যবহার করে তাও আবার অন্য শ্রমিকের শ্রমের ফলেই সৃষ্ট। ফলে বিনিময় প্রথায় শ্রমিক যেমন উৎপাদক তেমনি শ্রমিক আবার ভোক্তাও। শ্রমশক্তি বিক্রি করে শ্রমিক যেমন মজুরি পায় তেমনি তার শ্রমশক্তি কিনে মালিক পায় মুনাফা। ফলে মজুরি ও মুনাফার দ্বন্দ্ব চলছেই। বেশি সময় কাজ, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, আধুনিক ব্যবস্থাপনা যেমন উৎপাদন বাড়ায়, তেমনি বাড়ায় মালিকের মুনাফা। সে কারণে সামন্ত সমাজে একজন রাজা-বাদশা যে পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন পুঁজিবাদে একজন মালিক তার চেয়ে বহুগুণ সম্পদের অধিকারী। এই সম্পদের বৈষম্য যে বেদনা ও বিক্ষোভের জন্ম দেয় সেখান থেকেই শ্রমিক আন্দোলনের শুরু। মুষ্টিমেয় মালিকের বিরুদ্ধে অসংখ্য শ্রমিকের এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অসংগঠিত এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বারবার। শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত এবং লক্ষ্যাভিমুখী করার জন্যই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে।
কিন্তু বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের বর্তমান ভূমিকা দেখে এই প্রশ্ন জেগে ওঠা স্বাভাবিক যে, ট্রেড ইউনিয়ন কি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে? স্বাধীনতা পূর্বে শ্রমিক আন্দোলন এবং দাবি আদায়ের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, তখন শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের নেতারা। মওলানা ভাসানীসহ অনেক নেতা সরাসরি শ্রমিক বিক্ষোভ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এক টানা ৬৬ দিন ধর্মঘট করে পাটকল শ্রমিকদের দাবি আদায় করেছেন, ঘেরাও আন্দোলন করে প্রফেট অব ভায়লেন্স আখ্যা পেয়েছেন, কিন্তু দালালির দুর্নাম গায়ে লাগতে দেননি। শ্রমিকের মজুরি ও মর্যাদার লড়াই সংগঠিত করেছেন কিন্তু নিজেদের সম্পদ ও সুবিধা বৃদ্ধির কাজ করেননি। এই শ্রমিক আন্দোলন যে শোষণবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল তার ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ শ্রমিকের বিপুল অংশগ্রহণ ঘটেছিল। স্বাধীনতার আগ শ্রমিকদের দাবি উচ্চকিত হয়েছিল, কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না এই শোষণবিরোধী সেøাগানে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয় সেখানে শ্রমিক রাজ, কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর যত সময় গড়িয়েছে ততই শ্রমিকদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত শ্রম আইন, পাকিস্তান শাসনামলে প্রবর্তিত আইন ও অধ্যাদেশ সত্ত্বেও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও পরিচালনা এত কঠিন ছিল না, যতটা বর্তমানে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক নেতাদের ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহ পাওয়ার প্রতি মোহ এবং ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া। ফলে ক্ষমতাসীনরা যেমন ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে তাদের অনুগত করে রাখছেন তেমনি শ্রমিক রাজনীতি হারাচ্ছে তার মর্যাদা। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শুধু পুঁজিপতি শ্রেণি ক্ষমতায় আসেনি শোষণকে নিরাপদ রাখতে শ্রমিক আন্দোলনকে ক্ষমতাহীন করে রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। শ্রমিক নেতাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, প্রধান মন্ত্রীও হয়েছেন কিন্তু স্বার্থরক্ষা করেছেন মালিকদের। এ ঘটনা স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে, সামরিক-বেসামরিক সব সরকার এই পথে হেঁটেছে।
স্বাধীনতার পর পাটকল, চিনিকল, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, স্টিল মিল, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ ভারী শিল্পগুলো জাতীয়করণ করা হয়। তখন সেসব প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে একটা বড় প্রভাব পড়ে। এরপর যারাই ক্ষমতায় এসেছে সিবিএগুলো সেই সরকারি দলের অনুগত হয়ে গেছে। এরপর বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হওয়ায় শ্রমিক রাজনীতিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ এক অর্থে শ্রমিকের দেশ। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি আর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৬ লাখ। নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে, মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩২ শতাংশ নারী। তাদের স্বল্প মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি নতুন ধরনের সংকট তৈরি করছে।
পুঁজিবাদ শক্তিশালী হওয়ার ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিস্তার ঘটেছে দ্রুতগতিতে। দেশের ৮৮ শতাংশ শ্রমিক কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই, মজুরিও কম। ফলে সব আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের গড় মজুরি শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় বরং আফ্রিকাসহ পুরো পৃথিবীতে সর্বনিম্ন। অথচ আমাদের ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে হয় সর্বোচ্চ না হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শ্রমিকের নিম্ন মজুরি মালিকদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার সুযোগ তৈরি করেছে, যার ফলে শুধু ধনবৈষম্য ও আয়বৈষম্য তৈরি হয়নি বিপুল অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে।
শ্রমিকের জীবনযাপনের প্রয়োজন মেটানোর চেয়েও কম মজুরি এবং অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা তৈরি করেছে বৈষম্য ও শোষণের এক অন্যায্য সমাজ। ফলে এটা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট যে, যত মাথাপিছু আয় আর জিডিপি যতই বাড়ুক না কেন, এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শ্রমজীবীদের দারিদ্র্য দূর করতে পারছে না। উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও মজুরি না বাড়ার অর্থ বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলা। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে এবং অপরাপর জীবনযাপন খরচ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফলে গড় মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে দেখা যায়, পাঁচ বছরে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে অন্তত ৫০ শতাংশ। কিন্তু এই শ্রম শোষণ ও বৈষম্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও দুর্বল শ্রমিক আন্দোলনের কারণে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। মাঝে মাঝে মজুরির দাবিতে শ্রম অসন্তোষ হলেও কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ, শ্রমিক আন্দোলনে সমাজ পরিবর্তনের ধারার দুর্বলতা এবং মালিকদের দেওয়া সুবিধার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হওয়া।
অন্যদিকে নতুন ধরনের শ্রম খাত গড়ে উঠছে এবং পুরনো ধারার ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। প্ল্যাটফরম ইকোনমি, গিগ ইকোনমি, আউট সোর্সিংয়ের ফলে স্থায়ী শ্রমিক বলতে কিছু থাকছে না। ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে আইনের বাধা এবং শ্রমিকদের জীবিকার অনিশ্চয়তার সঙ্গে বেকারত্ব ও কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগের পরিমাণ বৃদ্ধিও শ্রমিক আন্দোলনকে কঠিন করে তুলেছে। সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুপস্থিতির কারণে।
কিন্তু বঞ্চনা বিচ্ছিন্নতাই তো শেষ কথা নয়, অধিকারের জন্য শ্রমিক পথে নামবেই এবং সেখান থেকেই গড়ে উঠবে নতুন ধারার ট্রেড ইউনিয়ন। এ ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরির আন্দোলন শক্তিশালী করতে হলে শ্রমিককে বুঝতে হবে কতখানি শ্রম দিয়ে বিনিময়ে সে কত পায়? মজুরি মালিকের কোনো দয়া নয়, এটা শ্রমিকের অর্জন বরং মজুরি কম দিলেই মালিকের মুনাফার জন্ম হয়। শ্রমিককে বুঝতে হবে তার শ্রমে কতটুকু মূল্য সংযোজিত হয়, উদ্বৃত্ত মূল্য কার ঘরে জমা হয়, রাষ্ট্র এবং মালিকের সম্পর্ক কী? মালিক অদৃশ্য মনে হলেও মালিকানা ব্যবস্থার জালে সে কীভাবে আটকে আছে। এই বিষয়গুলো বুঝতে না পারার কারণে পুরোন ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে আর নতুন ধারা শক্তিশালী হচ্ছে না। তাই অতীতের স্মৃতি আর পথ দেখাবে না, নতুন পথেই হাঁটতে হবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে।
লেখক: বাসদের কেন্দ্রীয় সহকারী সম্পাদক ও কলাম লেখক