ডেস্ক রিপোর্ট
২১ মার্চ ২০২৩, ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ
আবু নাসের অনীক::
‘উন্নয়ন’ খুবই চিত্তাকর্ষক একটি শব্দ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। এই শব্দটির বিনিময়ে দেশের একটি শ্রেণির মানুষের হাতে এসেছে আলাদিনের চেরাগ। ঘসা দিলেই কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষ হয়েছে নি:স্ব থেকে নি:স্বতর।
উন্নয়ন বলতে কি বোঝায়? মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র অথবা পরিবেশের জন্য চরম হুমকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র? আর মেট্রো রেল, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, ওভার ব্রীজ? সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোকেই ফেরি করে বেড়ানো হয় উন্নয়নের নমুনা হিসাবে।
দেশ না-কি এসডিজি পূরণের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে! UN, SDG সম্পর্কে বলছে, ‘The Sustainable Development Goals (SDGs) aim to transform our world. They are a call to action to end poverty and inequality, protect the planet, and ensure that all people enjoy health, justice and prosperity.’
এবার বাংলাদেশের উন্নয়নের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমেই দারিদ্রতা বিমোচন এবং বৈষম্য হ্রাস। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং(সানেম)য়ের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ি, দেশে বর্তমান দারিদ্রের হার ৪২ শতাংশ। হাউস হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিলো ২১.৮ শতাংশ।
অর্থাত এই কয়েক বছরে সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারের সাথে সাথে দারিদ্রতাও বেড়েছে। কেন বেড়েছে? প্রথমতো, কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার মারত্বকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সরকারি তথ্যনুসারে, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ৬.৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার ২০২০-২১ অর্থ বছরে দাঁড়ায় ৩.১৭ শতাংশে।
দ্বিতীয়তো, বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বেকারত্বের হার সর্বকালের সর্বচ্চো পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিবিএস এর তথ্য অনুসারে, গত নভেম্বর ২০২২ দেশে বেকারত্বের হার ৬.৯১ শতাংশে পৌঁছেছে। আইএলও প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ-২০২২ এর তথ্য অনুসারে, তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০.৬ শতাংশ। অন্যদিকে টিআইবি’র এক সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার।
কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না। সমস্যাটি ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠলেও এ বিষয়টি সমাধানের সমন্বিত কোন উদ্যোগ নেই। বুঝতে পারছেন তো, উন্নয়নের জোয়ারে আসলেই সবকিছু ভেসে যাচ্ছে!!
দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার তৃতীয় কারণ, উন্নয়নের ‘ট্রিকল ডাউন’ বা চুইয়ে পড়া তত্ত্ব কাজ করেনি। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ঘটলেও তা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কোন প্রভাব রাখেনি। দেশে সম্পদ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ সুফলভোগীর সংখ্যা যেহারে বাড়ছে সে অনুপাতে বরাদ্দ বাড়ছেনা। এই কর্মসূচির আওতায় সুফলভোগীরা কোনরকমে দিনাতিপাত করছে মাত্র।
অন্যদিকে বাজেটে সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নে গুরুত্বহীনতা। এই সবকিছু মিলিয়ে দারিদ্রতার হার ক্রমান্বয়েই বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চলছে উন্নয়নের জোয়ারের মহা তুফান। সামনে আবার নির্বাচন।
এবার আসা যাক Inequality বা অসমতা প্রসঙ্গে। উন্নয়নের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এটা লোপ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে এর পরিসংখ্যান কি বলে? প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব এর অসাম্য প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২’ এ বলা হচ্ছে,২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত। বিপরিতে নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট আয়ের ১৭.১ শতাংশ। যা দারিদ্রতার সাথে সাথে বাংলাদেশকে একটি অসাম্যের দেশ হিসাবে রূপ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স ‘গ্লোবাল এইচএনডব্লিউ অ্যানালাইসিস: দ্য হাই নেট ওর্থ হ্যান্ডবুক’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১.৪ শতাংশ হারে বাড়বে।
দেশ এখন লুটপাটের অভয়রাণ্যে পরিণত হয়েছে। সিএজি- এর বিগত চার বছরের অডিট রিপোর্ট সেটারই সাক্ষ্য দেয়। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিএজি এর রিপোর্টে মোট ৫৯ হাজার ৪৬৬ টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধুমাত্র ব্যাংক খাত থেকেই লুটপাট হয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। ৪০-৫০ টি পরিবারের হাতে দেশের ব্যাংক খাত কুক্ষিগত। এর মধ্যে একটি পরিবারের হাতেই রয়েছে ৭ টি ব্যাংক ও ১ আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
জিএফআইয়ের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাঁচার হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে পাঁচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাঁচারে শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্জিত অর্থ নিশ্চয় পাঁচার হয়না। সেই অর্থই পাঁচার হয় যা দেশে বৈধতা পায় না। দারিদ্রতা, বেকারত্ব, আয় বৈষম্য, সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া, আর পাঁচার প্রত্যেকটি এক অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর সবগুলিই যেমন স্বতন্ত্রভাবে, তেমনি যৌথভাবে নির্দেশ করে উন্নয়নের যে শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে প্রকৃতঅর্থে তা জনগণের সাথে প্রতারণার নামান্তর!
এসডিজি’র উন্নয়নে বলা হয়েছে, পৃথিবীকে রক্ষা করা; অর্থাত সুস্থ পরিবেশ। ইপিআই ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশ দূষণে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭ তম।
বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট এর প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মারা গেছে দুই লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। আসুন, আমরা বাদ্যের তালে তালে বলি ‘উন্নয়ন’ ‘উন্নয়ন’ একেই বলে উন্নয়ন!
বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। ‘ইন্টারন্যাশনাল এনসিডিস কনফারেন্স-২০২২ বাংলাদেশ’ এর সম্মেলনে বলা হয়েছে, দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে অপরিণত মৃত্যু বাড়ছে। প্রতি ১০ জনে ৭ জন মারা যাচ্ছে অসংক্রামক রোগে। অর্থাত মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক কারণে।
যে দেশে অসংক্রামক রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় বুঝতে হবে, সেখানে জনস্বাস্থ্য চরমভাবে হুমকির মুখে রয়েছে। আমাদের জনস্বাস্থ্য হুমকিতে। অন্যদিকে আমরা উন্নয়নের সাতকাহন প্রচারে ব্যস্ত। কি নির্মম রসিকতা।
উন্নয়নের পূর্বশর্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। পরিসংখ্যান কি বলে? আসক এর পরিসংখ্যান অনুযায়ি, ২০০১-২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যকান্ড ঘটেছে ৩ হাজার ৩৬৪ টি। ২০১২ সালে সংঘটিত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত পিছিয়েছে ৮৫ বার।
আলোচিত ত্বকী, তনু, মাহমুদা এমন আরো হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি এখনও। সেটা না হওয়ার কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া। সুশাসনের অনুপস্থিতি। বিভিন্নভাবে বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত হওয়া।
সরকার যে উন্নয়নের কথা বলে সেটা মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ। আর মেগা প্রজেক্ট মানেই শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া। উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, দেশ এখন বিপথগামী উন্নয়নের পথে হাঁটছে।
বিপথগামী উন্নয়নের লক্ষণগুলি কী? পরিবারতন্ত্র দেশ পরিচালনা করে। এদের ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করা;বিচার,নির্বাচন ব্যবস্থা এধরণের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে ফেলা হয়।
ভৌত অবকাঠামো, বিশেষত দৃশ্যমান মেগা প্রকল্পকেই উন্নয়নের মানদন্ড হিসাবে চিহ্নিত করে সেটিই জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। জনগণ সেটির পরিপূর্ণ সুফল পাচ্ছে কিনা এটা বিবেচ্য বিষয় থাকেনা।
ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর বরাদ্দের মধ্যে ভারসাম্য থাকেনা। অর্থাত ভৌত অবকাঠামোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এধরণের খাতগুলিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেনা। তাদের একমাত্র নজর থাকে প্রবৃদ্ধির দিকে। অথচ সম্পদ ও আয়ের সুষম বন্টন নিশ্চিত না করতে পারলে সেটি কখনওই উন্নয়ন হয়ে ওঠেনা।
আমাদের সমস্বরে বলার সময় এসেছে, আমরা আর তথাকথিত এই ‘উন্নয়ন’ এর বটিকা খেতে চাইনা। আমরা সেই উন্নয়ন চাই ,যার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে দারিদ্রতা কমে আসবে, সমতা সৃষ্টি হবে,বসবাস উপযোগি সুস্থ একটি পরিবেশ থাকবে, লুটপাট বন্ধ হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী