ডেস্ক রিপোর্ট
২২ এপ্রিল ২০২২, ৯:০৯ অপরাহ্ণ
আবু নাসের অনীক::
নিউমার্কেটের দুই দোকানের দুই কর্মচারীর ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ১৯ ঘন্টা ধরে সংঘর্ষ সংঘটিত হলো। একদিকে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী আর তাদের কর্মচারী অন্যপক্ষ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একাংশ। অনুবীক্ষণিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটি পরিণত হলো এক বিস্তৃত রক্তক্ষয়ী-জীবনহানী সংঘর্ষে।
প্রান্তিক শ্রেণীর দুই যুবক নাহিদ আর মোরসালিনকে প্রাণ দিতে হলো কেনো? কেনো ব্যক্তি দ্বন্দ্বের ঘটনাটি এমন বিস্তার লাভ করলো? আমাদেরকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। শুধুমাত্র উত্তর খুঁজলেই হবেনা এর প্রতিকারের ব্যবস্থাও করতে হবে। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’।
কলেজের শিক্ষার্থীদের একাংশের সাথে কেনো ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে? ছাত্ররা কলেজে আসে পড়াশোনা করার জন্য। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে। তাহলে সংঘর্ষ কেনো? দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে। ছাত্রদের (সরকার দলীয়) স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হচ্ছে এখানকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়। এই আদায়কে নিশ্চিত করার জন্য কলেজের সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন (কখোনো ছাত্রদল কখোনো লীগ) তাদের আধিপত্য বিস্তার করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে কেনো চাঁদা দেয়? আর চাঁদা কী তারা শুধুমাত্র ছাত্রদের দেয়? পুলিশকেও দেয়। মূলত এখানকার ব্যবসায়ীরা আইন মেনে ব্যবসা করেনা। এদের অর্ধেকের বেশি অংশের ট্রেডলাইসেন্স নেই, সরকারকে ট্যাক্স দেয়না, অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে। এই অবৈধ সুযোগ প্রাপ্তির জন্যই পুলিশকে যেমন চাঁদা দেয় তেমনিভাবে কলেজের সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরকেও (এখন ছাত্রলীগ) দেয়।
৫১ বছরে আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করলাম যেখানকার ব্যবসায়ীদের চরিত্র লুটেরা, এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছি যেখানে ছাত্ররা হয়ে উঠছে বিকৃত, নৃশংস, বিবেক বিবর্জিত, হায়েনার ন্যায় হিংস্র প্রকৃতির খুনী। যার সর্বশেষ বলি হলো কুরিয়ার কর্মী নাহিদ (ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর তাকে নির্মমভাবে আঘাত করে হত্যার দৃশ্য) আর দোকান কর্মচারী মোরসালিন।
এঘটনার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে নিউমার্কেট এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীরা সাধারণ ক্রেতাদের সাথে মস্তানীসুলভ ব্যবহার করে, যার সাক্ষী অবশ্য আমি নিজেই। একজন ক্ষুদ্র দোকান কর্মচারী কেনো এমন ব্যবহার করবে? করার যৌক্তিক কারণ এই লুটেরা সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান।
বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাতন্ত্র-লুটপাটতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্র জারি রেখেছে সমাজে-রাষ্ট্রে। তাদের এই শাসনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব সমগ্র সমাজে মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে দোকানের কর্মচারীরা, সেইসাথে ছাত্রদের একাংশ, বাদ পড়েনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী তার গুন্ডাতন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে সমাজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বলি হয়েছে নাহিদ আর মোরসালিন, কিছুদিন আগে হয়েছে প্রীতি। এমন আরো অনেক মৃত্যুই সামনে ঘটবে এটা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশে চলছে এক কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সকল অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে।
দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে বলা যায় কম্পিটিটিভ অথোরিটারিয়ানিজম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Steven levitsky বলেন,‘In a country where elections are rigged, the ruling party abuses state power, manipulates elections, denies opposition seats, harasses opposition candidates and their supporters, curtails media freedom and spies on journalist, opposition leaders and government critics, threatening even arresting or deporting-those countries are not democracies, but competitive authoritarian ones.’
এধরনের শাসন ব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী উন্নয়নকে সামনে রেখে সবকিছু জাস্টিফাই করার চেষ্টা করলেও উন্নয়ন খুব বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি মহিরুহ হয়ে ওঠে। চুড়ান্তভাবে সমাজের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং সেটি আড়াল করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধনে একের পর এক ঘটনা তৈরি করা হয়, যাতে নাগরিকরা সেসমস্ত ঘটনা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ফলশ্রুতিতে জনজীবনের সকল সংকট আড়াল হয়ে যায়। জনগণের মধ্যে নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাময়িক উত্তেজনা তৈরি হলেও তা প্রশমিত হতে সময় লাগে না। কারণ তারা প্রত্যেকটি ঘটনায় ব্যক্তিকেন্দ্রীক প্রতিবাদ করে। সিস্টেমটি অক্ষত থেকে যায়, যা ক্রমান্বয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সাথে যার মিল শতভাগ। দেশের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। সম্প্রতি গুলিতে নিহত প্রীতি, নিউমার্কেটের সংঘর্ষে নিহত নাহিদ বা মোরসালিনের পরিবার হতাশ কন্ঠে বলেছেন তারা বিচার চান না। নিহত মোরসালিনের ভাই বলেন,‘এই দেশে কোন বিচার নেই, কে করবে বিচার।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন,‘গ্রামেগঞ্জে যাবেন, র্যাব ইজ আ ব্র্যান্ড নেম, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য র্যাব ব্র্যান্ড নেম’। প্রশ্ন হচ্ছে একটি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব কার? একটি বিশেষ বাহিনীর নাকি বিচার বিভাগের? সার্বজনীনভাবে এর উত্তর বিচার বিভাগ হলেও আমাদের প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় এই দায়িত্ব পালন করছে র্যাব । অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থা যে অকার্যকর সেটা মন্ত্রী নিজেই ক্লারিফাই করেছেন।একইসাথে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে ‘ন্যায়বিচার’ হিসাবে বোঝাতে চেয়েছেন। এটা একটা জংলি- বর্বর রাষ্ট্রব্যবস্থার উদাহরণ।
একারণেই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বলি প্রীতির বাবা বেদনাহত হয়ে হতাশ কন্ঠে বলেন,‘মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।’ মোরসালিনের মা বলেন,‘আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম’। যখন নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে বিচার না চেয়ে ‘আল্লাহ’র কাছে বিচার চায়, কথা বলা অধিকার সংকুচিত হয়ে আসে, নাগরিক তার বিভিন্ন অধিকার (ভোট প্রয়োগসহ অন্যান্য) থেকে বঞ্চিত হয়, ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বাস করে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন মানুষের মনে একদিকে প্রবল হতাশার জন্ম হয় অন্যদিকে তার মধ্যে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হয়।
হতাশার কারণে নাগরিক হিসাবে সে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভূগতে থাকে। কার্যকর প্রগতিশীল রাজনীতির অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ সেই জায়গাটি দখল করে। তার মধ্যে ধর্মান্ধতাও তৈরি হয়। রাষ্ট্রের সহিংস আচরণের প্রভাব পড়ে সাধারণ নাগরিকের উপর। তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও নৃশংস মনোভাব গড়ে ওঠে। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যার ফলাফল আমরা দেখতে পেলাম নিউমার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনায়।
নিউমার্কেটের ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য সরকারী দলের সা:সম্পাদক বলেছেন,‘বিএনপি আমলে নিউমার্কেট প্রতিদিন রণক্ষেত্র ছিল’। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসাবে যেখানে তাঁর দায়িত্ব নিয়ে ১৯ ঘন্টার সংঘর্ষে নিহত, আহত আর নাগরিক দুর্ভোগের জন্য ক্ষমা/দুঃখ প্রকাশ করা উচিত, সেখানে তিনি বিএনপি’র শাসনামলের সাথে তুলনা করে স্বস্তি প্রকাশ করছেন!! কতোটা নিম্নমানের রাজনৈতিক রুচি হলে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা সম্ভব হয়!
আমাদের কিছু প্রগতিশীল বন্ধু নাহিদ-মোরসালিন হত্যার বিচার দাবি করে শাহাবাগে দাঁড়াতে চেয়েছেন। ভালো উদ্যোগ, ধন্যবাদ আপনাদেরকে। আহ্বান থাকবে, বরাবরের মতো শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রীক বিচার দাবি না করে কেনো প্রীতি, নাহিদ, মোরসালিনদের এভাবে মৃত্যু হয় সেই প্রশ্নটি উত্থাপন করুন। এই লুটেরা ব্যবস্থাপনার যিনি নির্বাহী প্রধান তার দিকে আঙ্গুল তুলুন।
বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জ না করে আপনি যতোই শাহবাগে দাঁড়িয়ে বিচার দাবি করে গলা ভেঙ্গে ফেলুন না কেনো তাতে লাশের সংখ্যা কমবেনা বরং আরো বাড়তেই থাকবে। কারণ এধরণের সিলেক্টিভ প্রতিবাদ শাসকগোষ্ঠীকে আগামীতে আরো অনেক ঘটনার জন্ম দেবার পথ তৈরি করে দেয়।
মনে রাখবেন প্রীতি-নাহিদ-মোরসালিন এর খুনী বা ত্বকী, সাগর-রুনী, তনু’র খুনীরা যেইহোক না কেনো তাদের ক্ষমতার উৎস কিন্তু এক ও অভিন্ন। সুতরাং প্রতিবাদটি হতে হবে এই ক্ষমতার উৎস উচ্ছেদের লক্ষ্যে।