ডেস্ক রিপোর্ট

৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৮ অপরাহ্ণ

সুষ্ঠু নাকি দৃশ্যমান নির্বাচন

আপডেট টাইম : জানুয়ারি ৬, ২০২৪ ১১:৩৮ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। ৭ জানুয়ারি এর সমাপ্তি হবে, ফলাফল ঘোষিত হবে কিন্তু নির্বাচন নিয়ে জটিলতার শেষ হবে না এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নির্বাচন হচ্ছে, জনমত যাচাইয়ের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু দেশের মানুষ সেটা যেন ভুলে যেতেই বসেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে একদলীয় নির্বাচনের যে ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছে, তাতে মানুষ ভাবছে ভোট দেব যেখানেই, পড়বে কিন্তু একখানেই। অর্থাৎ এক দলের পক্ষেই যাবে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন হচ্ছে, প্রতিযোগিতা হচ্ছে এক ব্যক্তির দুই হাতের মধ্যে, কোন হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে তা বাছাই করার মতো। ২০১৪, ২০১৮-এর ধারাবাহিকতায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ২০২৪-এর নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। হয়তো পৃথিবীর কোন কোন দেশ এই পদ্ধতি তাদের দেশেও প্রচলন করতে পারে।

জনগণের সেবা করার জন্য সুযোগ পেতে মরিয়া হয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। একবার নির্বাচিত হলে পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেবেন তারা। কিন্তু সেবা করার সুযোগ পাওয়া অত সহজ নয়। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। নমিনেশন পাওয়া থেকে শুরু করে, নির্বাচিত ঘোষণা করা পর্যন্ত কত জটিল পথ পারি দিতে হয় প্রার্থীদের। এসব মানুষ দেখে। কিন্তু ভেতরের কথা হলো, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিজেদের শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি হলো নির্বাচন। কিন্তু এই শাসক নির্বাচনটাও শাসিতরা সুষ্ঠুভাবে করতে পারছে না। ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ এক দীর্ঘসময় পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন। এ সময় ব্যালট পেপারের হেলিকপ্টার ভ্রমণ থেকে ডামিপ্রার্থীর নির্বাচন দেখা হয়ে গেল। নির্বাচন উৎসবের পরিবর্তে জনগণের কাছে আতঙ্ক আর প্রার্থীদের জনগণের টাকায় আখের গোছানোর প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। জনমত বা জনচেতনা সৃষ্টির পথ দিন দিন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ছে।

নির্বাচনী প্রচারণার শেষ জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন ভ-ুল করার চক্রান্ত চলছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে হাল্কাভাবে নেওয়া উচিত নয়। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি ধারণা করেন এবং সিদ্ধান্ত দেন। ফলে নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম এবং বৃহৎ সহযোগী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেছেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে। তবে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন কিনা বা ভোট দিতে পারবেন কিনা আর ভোট দিলেও সঠিকভাবে গণনা করে ফলাফল সুষ্ঠু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি আরও বলেছেন, বিশ^াস করে এসেছি কিন্তু আশ^স্ত হতে পারিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার আক্ষেপ, সরকার কি শান্তিতে আছে? বিএনপি কি শান্তিতে আছে, আমরা কি সুখে আছি? এই অশান্তি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি আওয়ামী লীগ না করে তার চাকরি নেই। ফেসবুকে একটা কটূক্তি করলে বলে রাষ্ট্রদ্রোহী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ভোটের অধিকার নেই। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। এই কথাগুলো কি উপেক্ষা করার মতো?

নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব যাদের হাতে সেই নির্বাচন কমিশন নানা চাপের মধ্যে থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ দৃশ্যমান করা এবং ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত পরিবেশ শান্ত রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো অংশ না নেওয়ায় এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কত মানুষ ভোট দিয়েছে সেই বিষয়। ফলে ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে যান, সেটা ইসির এখন অন্যতম প্রধান দুশ্চিন্তার বিষয়। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সম্ভাব্য কার্যক্রম সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখতে নাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বলা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যক্রমও যেন দৃশ্যমান থাকে।

শুক্রবার থেকে সারাদেশে ৬৫৩ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। তারা তাৎক্ষণিক বিচারের মাধ্যমে (সামারি ট্রায়াল) দোষীকে সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। ইভিএম নিয়ে নানা বিতর্ক ও ডলার সংকটের কারণে শেষ পর্যন্ত এবার নির্বাচন হচ্ছে ব্যালটে। নির্বাচন নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে দুর্গম ও চরাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত প্রায় তিন হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটের আগের দিন শনিবার ব্যালট পাঠানো হবে। বাকি ৩৯ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার যাবে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম ও চরাঞ্চল বিবেচনায় এই তিন হাজার ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ। এবার নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১৪৯ আর ভোটার সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ। ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, গত নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে। এবার যাতে ওই অভিযোগ না ওঠে, সেই সতর্কতা থেকে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায় আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে। ৭ জানুয়ারি রবিবার ২৯৯টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। একজন বৈধ প্রার্থী মারা যাওয়ায় নওগাঁ-২ আসনের ভোট বাতিল করা হয়েছে। আশঙ্কা ও হতাশার এ নির্বাচনে যে কোনো বিশৃঙ্খলা যেন মোকাবিলা করা যায় সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য মাঠে রয়েছেন। তাদের পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন ৩ হাজার।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। ইসির হিসাব অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ১৯৭০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন ২৬৬টি আসনে। বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে, আশঙ্কার কথা জানিয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচন থেকে বেশ কয়েকজন প্রার্থী সরে গেছেন। তারা নির্ধারিত সময় প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় ব্যালটে নাম থাকবে। ১৬টি নিবন্ধিত এবং আরও বেশ কয়েকটি ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছে। ইতিমধ্যে ভোটগ্রহণ সামনে রেখে নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। ফলে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ও আশঙ্কা বিরাজ করছে নির্বাচন নিয়ে।

এ যাবৎকালে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষ ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রতিটি নির্বাচনে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচনকালীন সহিংসতা। কিন্তু এবারের চ্যালেঞ্জ যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের প্রধান বিবেচনা যে ভোটারদের ভোট সেই ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন কিনা সেই চ্যালেঞ্জটাই এখন বড়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যাতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসেন তার ব্যবস্থা করছে ক্ষমতাসীন দল। ডামি প্রার্থী, নানা ধরনের ভাতা সুবিধাপ্রাপ্তদের প্রকাশ্য ও গোপন ভয় দেখানো, কর্মী সমাগম বাড়ানোর জন্য নানা সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটারদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিগত নির্বাচনে যানবাহনের ওপর যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, এবার তা অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে। তথ্য পাওয়ার সুবিধার্থে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে একটি মিডিয়া সেল স্থাপন করা হয়েছে।

নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের বিষয়ে আলোচনা করে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা সদস্যদের তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম যেন দৃশ্যমান হয় সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কথা বলেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব। তিনি জানিয়েছেন নির্বাচনে বড় ধরনের নাশকতার শঙ্কা নেই। প্রশ্ন উঠে, তাহলে কেন এত তৎপরতা, আর প্রধানমন্ত্রীই বা কেন বলেছেন আশঙ্কার কথা? ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক তো আবার গুপ্তহত্যার নীলনকশার কথাও বলেছেন।

বাস্তব পরিস্থিতি কী বলে? দলীয় প্রার্থী আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংঘাত হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের সমস্যা হলো কাকে ধরবে তারা। দুদলই তো একদলের মানুষ এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। বিগত দিনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া একদিনেই ৪০টির বেশি ঘটনায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি সূত্রে পত্রিকায় প্রকাশ, ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ৫৮৯টি শোকজ নোটিস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৪টি ঘটনার তদন্ত করে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে কমিটি। এর মধ্যে ২৯১টি ঘটনায় সত্যতা পাওয়া গেছে। ৯৩টি অভিযোগের সত্যতা পায়নি কমিটি। ইতিমধ্যে ১২০টি প্রতিবেদনের ওপর সিদ্ধান্ত দিয়েছে ইসি। নির্বাচনসংক্রান্ত এক সভায় সিইসি বলেছেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ আছে। আমরা আশা করি, নির্বাচন ও ফলাফল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

কিন্তু সাধারণ মানুষ বলছে অন্য কথা। যেখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরাই অংশ নেয়নি, সেখানে অংশগ্রহণমূলক কীভাবে হবে? আর নির্বাচন স্বচ্ছ হলেও গ্রহণযোগ্য হওয়ার পথ কি খোলা আছে? ইতিমধ্যে যত রক্ত ঝরেছে এবং যে রকম আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে তাতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়া বা নির্বাচনের পর শান্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ভোটকেন্দ্রের সামনে লাইন করে লোক দাঁড় করিয়ে রাখা অথবা বুথ জ্যাম করার পদ্ধতি অনেক পুরনো। ব্যালট পেপারে জালভোট এবং সিল মারার অভিজ্ঞতাও কম নেই। এসব করে ভোট বাড়িয়ে শতাংশের হার বেশি দেখিয়ে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা অতীতে হয়েছে বহুবার। সেই পথে হাঁটলে দৃশ্যমান ভোট সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে না।

লেখক: বাসদের কেন্দ্রীয় সহকারী সম্পাদক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন