ডেস্ক রিপোর্ট

৪ মে ২০২৪, ২:৪৩ অপরাহ্ণ

মূল্যস্ফীতি মজুরি মে দিবস

আপডেট টাইম : মে ৪, ২০২৪ ২:৪৩ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

প্রকৃতি এবং সমাজে যে সংকট আসে, তা সবার জীবনে এক রকম যন্ত্রণা তৈরি করে না। ৭৬ বছরের ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বা দাবদাহে যেমন অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, তেমনি বাজারের উত্তাপও ঝলসে দিচ্ছে তাদের জীবন। কিন্তু যাদের সামর্থ্য আছে তারা বাসায়, অফিসে এবং যানবাহনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পান। আর হাতে পর্যাপ্ত টাকা আছে বলে বাজারের উত্তাপ তাকে কোনোভাবেই কাবু করতে পারে না। এই সামর্থ্য বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই অর্জিত হোক না কেন, তাদের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি হবে না। কারণ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ব্যক্তি পর্যায়ে কর দিতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা ৭৮ লাখ। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। কিন্তু যারা কর দেওয়ার মতো আয় করেন, তাদের সবাইকে উচ্চবিত্ত বলা যায় না। ফলে ধারণা করা যায়, দেশের অন্তত ৫ শতাংশ মানুষ এমন আয় করেন যে, নিত্যপণ্যের মূল্য যাই হোক না কেন তাদের গায়ে তার উত্তাপ লাগে না। কিন্তু সমস্যা হলো, এরাই থাকেন সংসদে, সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নকারী সংস্থায় এবং তাদের মতটাই প্রচারিত হয়, গুরুত্ব পায় সমস্ত ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছে, তারা ‘সাধারণ’ বলেই গুরুত্বহীন। প্রকৃতির উত্তাপ বৃদ্ধি আর বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে তাদের কোনো হাত না থাকলেও এর পুরো দায় বহন করতে হয় তাদেরই।

সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বলতে পছন্দ করেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি বিশ্বব্যাপী ঘটছে। এর কারণ হলো, করোনার সময় অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় বৈশ্বিক মন্দা। ফলে দেশের অর্থনীতির সংকট দেখা দিয়েছে। যদিও দেশের অর্থনীতি আগে থেকেই নানা সংকটে আক্রান্ত ছিল। যা হোক, এ ত্রিমুখী সংকটে আক্রান্ত হয়ে পড়া অর্থনীতিকে রক্ষা করতে তাদের ভূমিকা কী ছিল এবং যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা যথার্থ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করা বা পথ অন্বেষণ করার কোনো সুযোগ তো নেই। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে মানুষকে উপশম দিতে সরকারের জনবান্ধব বাজেট করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে সরকার বাজেটে করের বোঝা চাপিয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সরকার নিজস্ব ব্যয় বাড়িয়েছে। এর মধ্যে জনকল্যাণে যতটুকু ব্যয় হয়েছে, এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে বিলাসবহুল প্রকল্পে। যেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো না করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বাজেটে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারত। উৎপাদনমুখী খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেত। কিন্তু সরকারে থাকা দল যখন মনে করে, আমরা যা করেছি ভালো করেছি, সমালোচক আর বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের কথা শোনার দরকার নেই। আর বিরোধী দল? কী ক্ষমতা আছে তাদের? ফলে দেশ চলছে, আমাদের মতো আমরা চালাব এই মানসিকতায়। এরই প্রভাব পড়ছে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে।

বাজেটের আয়তন বড় করার একটা প্রবণতা খুবই শক্তিশালী। কিন্তু বাজেট বড় করলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ফলে সরকারকে ব্যয় নির্বাহ করতে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণ নিলে অসুবিধা নেই। প্রশ্ন হলো, ঋণের টাকা খরচ হচ্ছে কোথায়? ঋণ নিয়ে সরকার অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করছে। এতে ঋণের বোঝা বাড়ছে। ফলে এ ঋণ জনগণের করের টাকায় সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাজেট ছোট করলে একদিকে ঋণের বোঝা কমানোর পাশাপাশি সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ছিল। কিন্তু কে করবে?

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে । ভারতে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রীলংকায় নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, তারা একে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে দরিদ্র, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশি আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। সরকারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে এখন যারা জড়িত, তারা সবাই উচ্চ আয়ের মানুষ। এর সঙ্গে আছে টাকা বা ডলার পাচারের সমস্যা। বছরে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেছেন। কিন্তু এই টাকা পাচার বন্ধ এবং পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এর সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। সিন্ডিকেট আছে কী নেই এ নিয়ে বিতর্ক সরকারের অভ্যন্তরে। কিন্তু মানুষ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছে, সিন্ডিকেটের কী ক্ষমতা।

আমদানিনির্ভর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডলার সংকট নিরসন করতে হলে যেমন টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে, তেমনি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে হুন্ডির কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। এখন রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স বা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে যেসব ডলার দেশে আসছে, সেগুলোর একটি অংশ আমদানি বা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। হুন্ডি বন্ধ হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় যেমন বাড়বে, তেমনই দেশ থেকে টাকা পাচার কমবে। এই পরামর্শ অর্থনীতিবিদরা ক্রমাগত দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু শোনার তাগিদ নেই।

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, ঋণখেলাপিদের তোষণ, রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া, নানা ধরনের জালজালিয়াতি, টাকা পাচারের কারণে ব্যাংকগুলো এখন বিপর্যস্ত। যে খাতটির অর্থনীতিতে টাকার জোগান দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা ছিল সে খাতের অনেক ব্যাঙ্ক এখন নিজেরাই ডুবছে। অনেক ব্যাংকে চাহিদা অনুযায়ী মূলধন নেই আবার আমানতের প্রবাহও কম। যদি ব্যাংক থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া না হতো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, খেলাপিদের নতুন ঋণ দেওয়া না হতো, জালজালিয়াতি বন্ধ করা হতো, সুশাসনের প্রয়োগ হতো তাহলে সম্ভব হতো ঋণ বা খেলাপির নামে টাকা পাচার বন্ধ করা । এ তো হয়ইনি বরং বিপরীতটাই ঘটেছে ব্যাপকভাবে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে যত্রতত্র। ব্যবহারও হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ঋণের কিছু অর্থ আবার পাচারও হয়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ঋণের সুদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। যে কারণে এখন ঋণ শোধ করতে বেশি অর্থ লাগছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ শোধ দেওয়া এখন অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে।

এই সংকটে সাধারণ মানুষ কী করবে? এসব অর্থনৈতিক বিষয় তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে একটা কথা চালু আছে, যাকে বলা হয় ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ বা স্বজন তোষণের পুঁজিবাদী পদ্ধতি। ব্যাংক, বাজার, ব্যবসা এমনকি নির্বাচন, সর্বত্র এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জীবনযাপন ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোনোমতেই।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে শ্রমজীবী মানুষের ওপর। দেশের ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমজীবী মানুষ যাদের শ্রমে দেশের উৎপাদন হয় সেবা, শিল্প ও কৃষি খাতে তাদের জীবন জেরবার হয়ে যাচ্ছে মজুরি আর মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সমন্বয় করতে করতে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে যে গতিতে, মজুরি সে গতিতে বাড়ছে না। ফলে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা যাচ্ছে কমে। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯.৮ শতাংশ আর শ্রমিকের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ। যদিও শ্রমিকরা যা খায় এবং ব্যবহার করে সেসব পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি ২০ শতাংশের মতো। তারপরও সরকারি হিসাবেই তো শ্রমিক মজুরি হারায় প্রায় ৫ শতাংশ। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করার কথা কিন্তু পাঁচ বছর কি দ্রব্যমূল্য, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ পানি জ্বালানি খরচ, ওষুধের দাম, শিক্ষার খরচ এমনকি টাকার মূল্য এক জায়গায় স্থির থাকে? দেশে বহু ধরনের কাজ থাকলেও মাত্র ৪৩টি সেক্টরে মজুরি পুনর্নির্ধারণ করার জন্য মজুরি বোর্ড আছে। শিল্প ও সেবা মিলে ৫৫টি খাতে নেই ন্যূনতম মজুরি। যে ৪৩টি খাতের মজুরি বোর্ড আছে তাদের মধ্যে ১৬টি খাতের মজুরি পুনর্নির্ধারণ হয়নি প্রায় তিন যুগ। মালিকরা যেখানে যেভাবে পারেন, সেভাবে মজুরি দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। বেকার ও কর্মহীন মানুষের দেশে উপায়হীন শ্রমিক বাধ্য হচ্ছে সেই বেতনেই কাজ করতে। ফলে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ আর আয় না বাড়ার এক সমাধানহীন সংকটে আটকে আছে শ্রমিকের জীবন। উন্নয়নের মহাসড়কে আর উঠতে পারছে না শ্রমিকের জীবনের গাড়ি। জিডিপি বৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় তাদের কাছে শুধু সংখ্যা মাত্র। মজুরির দাবিতে অসন্তোষের বিস্ফোরণ তাই ঘটছে মাঝে মাঝেই।

এ রকম পরিবেশেই এবার শ্রমজীবী মানুষ পালন করলেন মহান মে দিবস। ১৩৮ বছর আগে যে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি উঠেছিল, আইএলও কনভেনশন আর শ্রম আইনে তার স্বীকৃতি থাকলেও ন্যায্য মজুরি না থাকায় শ্রমিক বাধ্য হচ্ছে অতিরিক্ত সময় পরিশ্রম করতে। কারণ বাড়তি কাজ না করলে এবং বাড়তি আয় না হলে তার সংসার চলে না। ফলে শ্রমিকের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে অবসরের আনন্দ। পুঁজিবাদী সমাজে মালিকের মুনাফা আর শ্রমিকের মজুরি নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব। মালিকের মুনাফা বৃদ্ধির প্রবণতার কাছে পরাজিত হয় শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির আকুতি। যে কারণে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি আইন করে নির্ধারণ করার দাবি উঠেছে বারবার। বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণ না করলে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার যে বাস্তবায়ন করা যায় না তা প্রমাণিত। পণ্যের মূল্য সৃষ্টি করে যে শ্রমজীবী মানুষ, তাদের মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে রক্ষা করতে ন্যায্য মজুরির হার নির্ধারণের কোনো বিকল্প নেই। বৈষম্য দূর করা, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আর সমাজের বিকাশের জন্য শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি ও ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের আন্দোলন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। প্রতি বছর মে দিবস সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় বারবার।

লেখক: সহকারি সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ

শেয়ার করুন