ডেস্ক রিপোর্ট

৩ নভেম্বর ২০২৪, ২:২৭ অপরাহ্ণ

বিপ্লব না কি গণঅভ্যুত্থান

আপডেট টাইম : নভেম্বর ৩, ২০২৪ ২:২৭ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক :

৫ আগষ্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মাইল ফলক তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এদেশের মানুষের জীবনে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী-স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এর পতন ঘটে।

ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রচেষ্টায় সহাস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে পতন হয় আওয়ামী সরকারের। এই সংগ্রামকে নানা নামে অভিহিত করা হচ্ছে। আবেগের আতিশয্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানকে কেউ বলছেন বিপ্লব!

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের প্রায় তিন মাস পর এসে বলছেন ওনারা ‘বিপ্লবী সরকার’ বা ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠন করবেন।

আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি বিপ্লব কি? এটি এমন এক প্রক্রিয়া যা পুরোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনে তার আমূল পরিবর্তন ঘটায়। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়।

জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে উঠে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিদ্যমান সংবিধানকে স্থগিত করে একটি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন করে। অবশ্যই পূর্ব নির্ধারিত একটি বিপ্লবী ইস্তেহারকে ভিত্তি করে; বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়েই জনগণের মধ্যে যা ঘোষিত থাকে।

সেই সরকার একটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সংবিধানসভা করে। সংবিধান সভার মাধ্যমে স্থগিত সংবিধানের স্থলে নতুন বিপ্লবী সংবিধান প্রণয়ন করে শাসন ব্যবস্থাকে তার অধীন করা হয়।

রাষ্ট্রকে যে সমস্ত স্তম্ভ টিকিয়ে রাখে সমস্ত জায়গাতে সংস্কারের পরিবর্তে একটি আমুল পরিবর্তন ঘটায়। এটাকেই বিপ্লব বলা হয়। বিপ্লব একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য একটি বিপ্লবী দল থাকে। সেই বিপ্লবী দলের অধীনে একটি সশস্ত্র বাহিনী থাকে। সশস্ত্র বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব সংঘটিত হয়।

একটি বিপ্লবী দলের বিপ্লব পরবর্তীতে সে কি করবে; কেমনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সাজাবে সেসমস্ত প্লানিং আগে থেকেই প্রস্তুত করা থাকে। দেশের অন্য সকল রাজনৈতিক দল সেই বিপ্লবী দলের অনুগামি হয়।

বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের সকল বাহিনী সেই বিপ্লবী দলের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। রাষ্ট্রে বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান বা দলের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। সেখানে অন্য আর কারো কোন ধরণের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না। অথবা অন্য কারো মতামত গ্রহণও করা হয় না।

অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান বলতে কি বোঝায়? জনগণের ব্যাপক অংশের দ্বারা নির্দিষ্ট দাবী আদায়ের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের শাসন অমান্য করে তাদেরকে জনগণের দাবী মানতে কিংবা ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করা। যেমন, ১৯৬৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের গণ-অভ্যূত্থান এবং ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের গণ-অভ্যূত্থান।

গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে অভ্যুত্থানকারী শক্তি বিদ্যমান সংবিধানের অধীনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কিছু সংস্কারের এজেন্ডা জনগণের সামনে তুলে ধরে। সেটি বাস্তবায়ন করার জন্য পূর্ববর্তী সরকারের প্রশাসনে বেশকিছু রদবদল সংঘটিত করে।

বিপ্লব এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে এক করে দেখার কোন সুযোগ নেই। দুটিকে এক করে যারা দেখাতে চাইছেন তারা প্রকারন্তরে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। গণঅভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরো দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার একটি প্রয়াস।

আসুন, উপরের আলোচনা অনুসারে আবেগের পরিবর্তে বাস্তবতার নিরিখে এবার আমরা দেখার চেষ্টা করি ৫ আগস্টের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ব্যবহারিকভাবে আসলে কি ঘটেছে।

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন-নির্যাতনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। গত এক দশক এর বেশি সময় ধরে এখানকার সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সেটা গণঅভ্যুত্থানে রুপ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো।

এমন একটি পরিস্থিতিতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে হত্যাকান্ড সংঘটিত করে বিগত সরকার। তীব্র জনবিক্ষোভের মুখে সরকার পতনের এক দফা সামনে চলে আসে।

৫ আগষ্ট বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের দাবীকে সামনে নিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হয়।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তিতে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বর্তমান সরকার শপথ গ্রহন করে। অর্থাত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে কিছু সংস্কার করতে চায়।

এখন হঠাত করে বলছেন, সংস্কার না বিদ্যমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে হবে। অথচ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার চায়। আমুল পরিবর্তন কখনওই চায়নি।

এবার আসুন বাস্তবতাটা কী? ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এটা কি কোন বিপ্লবী সত্তা ছিলো অথবা কোন বিপ্লবী দল? এর কোনটিই না। এটি ছাত্রদের একটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম ছিলো।

যে প্লাটফর্মটিতে দেশের সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন একসাথে যুক্ত হয়েছিলো কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে। এমনকি এই প্লাটফর্মে বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাও অংশগ্রহণ করে।

যে সকল ছাত্র সংগঠন (বাম-ডান) যুক্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমন করতে যেয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে।

এমন পরিস্থিতিতে ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। সকলের কমন ইন্টারেস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন।
এর মধ্যে কোন একটি রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কি স্থগিত ঘোষণা করে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে? করে নাই তো।

রাষ্ট্রের বাহিনীগুলো কি ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে? করে নাই তো। একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এটা ঠিক এই সরকার আপনাদের দ্বারা মনোনীত।

এই সরকারকে এখন আপনারা বিপ্লবী সরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। যারা উপদেষ্টা আছেন এদের তো কারো সাথেই কারো চিন্তার বা মতাদর্শের পর্যন্ত মিল নেই। এক একজন এক এক গ্রহের মানুষ।

আপনারা কি চাইছেন সেটা তো আপনারা নিজেরাই দেশের জনগণের কাছে পরিস্কার করতে পারেন নাই। এখন আবার বলছেন জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ‘স্পিরিটের আলোকে’ এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে ‘প্রক্লেমেশান অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করতে হবে।

সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলছেন, ‘আমাদের চব্বিশের যে বিপ্লবটা হয়েছে এ বিপ্লবের স্বীকৃতিটা আমরা চাচ্ছি। প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক চাচ্ছি। যেটার মাধ্যমে সংবিধানকে বাতিল করে পুরো কলাকানুনকে এ প্রক্লেমেশনের আন্ডারে নিয়ে আসা হবে’। (২৩ অক্টোবর ২০২৪-বিবিসি)

আরে ভাই চব্বিশে তো বিপ্লব হয় নাই। তো বিপ্লবের স্বীকৃতি আসবে কোথা থেকে। আবেগ দিয়ে বিবেচনা করলে তো হবে না সবকিছুকে। আবেগ দিয়ে তো রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন,‘আমরা জানি যে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল একটা রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতার ঘোষণা-পত্রে ছিল। প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক একটিই। সেই রিপাবলিকটি কর্তৃত্ববাদী শাসকের কারণে গত পাঁচ দশকে ফাংশন করেনি ভালোভাবে। তবে এর দায় শাসকদের।

‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সমালোচনা পরবর্তী সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করা হয় নি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ যদি থাকে তাহলে তো ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রও থাকে। সেটা বাহাত্তরের সংবিধানেরও আগে। সেটার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ও হয়েছিল, একটা সরকারও হয়েছিল ওই সময়। সুতরাং সেখানে একটা রিপাবলিক ঘোষণা হয়েছিল। পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বলা হয়েছিল।’(২৩ অক্টোবর ২০২৪-বিবিসি)

তাহলে আমার প্রশ্ন ৭১ কে যদি আপনারা স্বীকার করেন তবে নতুন করে ২৪এ এসে ‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ কেন লাগবে? সেটি যদি আপনাদের লাগেই তাহলে ইনিয়ে-বিনিয়ে না বলে স্পষ্ট করে বলুন, আপনারা ৭১ কে ডিজঅন করছেন।

আগামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমনভাবে পরিচালিত হবে সেটি যদি আপনাদের প্রক্লেমেশন এর লক্ষ্য হয় তবে আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার রুপরেখা নিয়ে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সংলাপ করুন।

আপনারা তো সমস্ত বিষয়টাকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে ফেলছেন। ২৪ এ বিপ্লব হয়নি। এর পরেও যদি আপনারা আবেগে আর গায়ের জোরে এটাকে বিপ্লব মনে করেন তাহলে তো আপনাদের কোন স্বীকৃতিরই দরকার নেই। কার কাছ থেকে স্বীকৃতি চাচ্ছেন?

আপনাদের একটা মব তৈরি করে পদত্যাগ চাওয়া বা এটাই করতে হবে, এখনই করতে হবে; আল্টিমেটাম ঘোষণা করা; আপনাদের দাবিসমূহের যৌক্তিকতা বিবেচনা না করে সেটি অন্যদেরকে মানতে বাধ্য করা এ সবকিছুই কিন্তু এক ধরণের ফ্যাসিস্ট আচরণের বহি:প্রকাশ।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটাই। স্বাধীনতা প্রাপ্তিও বাংলাদেশে একটাই। যার জন্য আমরা একটা পতাকা; একটি ভূখন্ড পেয়েছি। নিজেদের একটি অর্থনীতি পেয়েছি। যেটা পাইনি সেটি হলে জাতীয় মুক্তি। তার জন্যেই ফিরে আসে গণঅভ্যূত্থান। আমরা একটি ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছি ৫ আগষ্ট। যেমন করে পতন ঘটিয়েছিলাম ৯০ এর ৬ ডিসেম্বর আরো একটি স্বৈরাচার সরকারকে।

আপনারা নিশ্চয় বুঝেছেন আমি এতক্ষণ যে আলোচনাটি করেছি তার আলোকে ৫ আগষ্টকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসাবেই নির্ণয় করা যায়। অন্যকিছু নয়। বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে হলে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বিপ্লবী প্রচেষ্টা থাকতে হবে। তার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নির্ধারন করতে হবে।

সেটি গণমানুষের একটি রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বেই সংগঠিত হবে। ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর মতো ব্যানারের নেতৃত্বে নয়। অন্য কোন পথে নয়।

এটা মনে রাখুন, কিলিয়ে কাঁঠাল যেমন পাকানো যায় না তেমনি একটি গণঅভ্যূত্থানকে জোর করে বিপ্লব বানানো যায় না। সেটি বানানোর চেষ্টা করলে দেশ অস্থিতিশীল হবে। সেটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের অর্জনকে ভূলুন্ঠিত করবে।

শেয়ার করুন