ডেস্ক রিপোর্ট
১২ অক্টোবর ২০২৪, ১:৫০ অপরাহ্ণ
রাজেকুজ্জামান রতন :
যে কোনো পরিস্থিতিতে যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে তাদের সুযোগসন্ধানী বলে। সুযোগ পেলেই তাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে দক্ষতা বলা হয়। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তাকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারেন যারা তারা হলেন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের কাছে সবচেয়ে যে বিষয়টি মজুদ থাকে তা হলো অজুহাত। যে কোনো অজুহাতেই তারা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে পারেন। বন্যা, খরা, শীত, দেশ থেকে বহুদূরে যুদ্ধ লাগলে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে কিংবা ঈদ, পূজা, নববর্ষ সব কিছুকেই তারা অজুহাত বানিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারেন। মানুষের আবেগ, উৎসব বা উৎকণ্ঠা সবই যেন মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষের ভোগান্তি বাড়ে কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কারণ তাদের আয় বাড়ে না। তাই জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয় মেটাতে সামনে কোনো পথ তারা খুঁজে না পেয়ে মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত একটাই পদক্ষেপ তারা নিতে পারে তা হলো সংসারের খরচ কমাও, খাওয়া কমাও।
সংসারের প্রথম প্রয়োজন খাবারের কথা ভাবলে, নিম্ন ও স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস ডিম ও ফার্মের মুরগি। ডিমের ডজন এখন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, দুই বছর আগেও বছরজুড়ে সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে মুরগির ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে দিনে কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি ডিমের চাহিদা আছে দেশে। তাহলে শুধু ডিমের জন্য প্রতিদিন বাড়তি টাকা লাগে প্রায় ১৩ কোটি। জনগণের পকেট থেকে বের করে নেওয়া এই টাকা কে পায়, কোথায় যায়?
শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের আমিষ ও পুষ্টির সহজ এই জোগানদাতা ডিমের দামও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সকালের নাস্তায় ডিম খেতে চাইলে একটা ছোট পরিবারেও শুধু ডিমের পেছনেই মাসে খরচ করতে হচ্ছে ১৫০০-১৭০০ টাকা। ডিমের দামের এমন ঊর্ধ্বলম্ফে হতভম্ব মানুষ। ইতিমধ্যে ভারত থেকে ৭ টাকার ডিম আসতে শুরু করেছে। তাহলে দেশের বাজারে ডিমের দাম ১৫ টাকা কেন? বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না ক্রেতারা। এক মাসে তিন দফায় বেড়ে ডাবল সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। বিভিন্ন বাজারে ব্রয়লার মুরগি এখন ২১০-২৩০ টাকা। দেশি মুরগির দাম ৬৫০-৬৮০ টাকা প্রতি কেজি। অন্যদিকে সোনালি কক বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৫০ টাকায়। চালের দামও বেড়েছে, সব থেকে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। প্রতি কেজি মিনিকেট নামের চাল ৭১-৭২ টাকা, আটাশ ৫৭-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকা, পাইজাম ৫৬-৬০ টাকা, সুগন্ধি চিনিগুঁড়া পোলাও চাল ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণহীন আগুন সবজির বাজারেও। মুলার কেজিও ১০০ টাকা। গাজরের কেজি ১২০ টাকা, বেগুনের কেজি ১৮০ টাকা। সব শেষ ভরসা হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে আলু সেটাও এখন ৭০ টাকা কেজি। করলার কেজি ৮০-১০০ টাকা, চিচিঙ্গা-পটোল-ঝিঙার কেজি ৬০-৮০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০-৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০-৭০ টাকা। কোনো তাজা সবজি ৭০-৮০ টাকার নিচে নেই। সবচেয়ে সস্তায় মিলছে শুধু কাঁচা পেঁপে, কেজি ৩০-৪০ টাকা। বিক্রেতাদের অজুহাত, বন্যার কারণে সরবরাহে ঘাটতি তাই দাম বেড়েছে সবজির। কিন্তু ক্রেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। আগে বলা হয়েছিল, উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ট্রাকে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে ঢাকায় সবজির দাম বেশি। পুরনো চাঁদাবাজরা তো পালিয়েছে তাহলে এখন প্রশ্ন উঠছে, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি নাকি সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে না?
মাছের বাজারে অবস্থা আরও কঠিন। পকেটে কম টাকা থাকলে ইলিশের দিকে তাকাতেও ভয় পান বেশিরভাগ ক্রেতা। এক কেজির ওপরে ইলিশ ২৫০০ টাকার কম নয়। ৭৫০ গ্রামের ইলিশ কিনতেও ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা লাগতে পারে। চাষের রুই-কাতলার কেজিও ৪০০ টাকা। চাষের কই কেজিপ্রতি ২৮০-৩০০ টাকা, শিং-মাগুর কেজিপ্রতি ৪৫০-৬০০ টাকা, বোয়াল ৭০০-৯০০ টাকা, আইড় ৭০০-৮০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা। ফলে পাঙাশ-তেলাপিয়া ছাড়া সাধারণ মানুষ অন্য মাছ কিনতে পারছেন না। সেই পাঙাশও প্রতি কেজি ২৮০-৩০০ আর তেলাপিয়া ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে । এত দাম কেন? জিজ্ঞেস করলে মাছ বিক্রেতারা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। একটু সদাশয় মাছ বিক্রেতা হলে বিক্রেতা বলেন, সব জায়গায় দাম বেশি আমরা কী করব? আড়ত থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। আর ইলিশের দাম এত বেশি কেন তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে এক গাল হেসে উত্তর দেন, মাছ তো সব রপ্তানি করে ফেলছে সরকার। কিন্তু ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা হলেও যে দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়, সে কথা তাদের কে বোঝাবে? শুধু খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা নয় ওষুধের দামও বাড়ছে ক্রমাগত। সেটা দেখবে কে? তাহলে দেশের পটপরিবর্তন হলেও বাজার সিন্ডিকেট কি একই থেকে গেছে? দায় এড়ানো যতই চলুক, বাস্তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের।
অর্থনীতির ভাষায় যাকে ইনফ্লেশন বলা হয়, বাংলায় তাকে বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি। এর কারণ হলো বাজারে পণ্য কম কিন্তু টাকার পরিমাণ অর্থাৎ চাহিদা বেশি। এই ধারণার কারণে ইনফ্লেশন কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভূমিকা পালন করতে বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ইনফ্লেশন কেবল মুদ্রাস্ফীতি নয়। তাই অর্থনীতিতে টাকার পরিমাণ কমিয়ে ইনফ্লেশন কমানো সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ইনফ্লেশনের মানে যাই হোক না কেন, মানুষ দেখছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এটাকেই বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পণ্যের মূল্য কেবল মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বাড়ে না। দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির অবস্থা ডাবল ডিজিট অর্থাৎ ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ শতাংশে পৌঁছেছে? বছর বছর মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে, সেটা এক কথা আর স্ফীত মূল্য হ্রাস হচ্ছে না কেন, সেটা ভিন্ন কথা। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির বিতর্কের চেয়ে বেশি আশা করে স্ফীত মূল্য কমে যাক। এর জন্য যে যে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকার সেই সব ব্যবস্থা নিক।
কেন সাধারণ মানুষ আশা করে স্ফীত মূল্য কমে যাক? কারণ মূল্যস্ফীতি তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে দেয় যার প্রভাব পড়ে পেট থেকে মাথায়। দৈনন্দিন খাবারে টান পড়ে আর জীবন যাপনের ব্যয় নির্বাহ করতে দুশ্চিন্তা ও ঋণের বোঝা বাড়ে। ধরা যাক, ২০২০ সালে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন ১২৫০০ টাকা আর গাড়িচালকের বেতন ১৯ হাজার টাকা ছিল। বেতন এখনো তেমনই আছে। অথচ চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, লবণ, চিনি সবকিছুর দাম বেড়েছে। তখন তারা কী করবে? বাজারে গিয়ে সরকারকে গালমন্দ করে আর বেতন বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করে। কাজ না হলে বিক্ষোভ, আন্দোলন করে। শ্রমিকরা সংগঠিত বলে রাস্তায় নেমে ক্ষোভ জানাতে পারে, কিন্তু নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত কী করবে? চাকরিজীবী বা সীমিত আয়ের মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ যারা ব্যাংকের জমানো টাকায় সংসার চালান তাদের বাজারের লিস্ট ছোট না করে উপায় নেই।
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা অনেকের কাছেই নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। সাধারণ মানুষ প্রতি মাসে বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে ৬০টি পণ্য কিনে থাকে, গড়ে সেগুলোর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিছু পণ্য আছে যেগুলোর দাম সামান্য বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ। আবার বাজারের তালিকায় এমন পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে অত্যধিক, অর্থাৎ ৩০-৪০ শতাংশ। যাদের আয় বেশি তাদের পণ্য ব্যবহারের তালিকা বড়। দাম বাড়লেও কিছু যায় আসে না। যাদের আয় যত কম তাদের তালিকা তত ছোট এবং প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তত বেশি হারে বাড়ে। ফলে সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অধিক মুদ্রা সরবরাহ, সরকার কর্র্তৃক অধিক মাত্রায় ব্যয়, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি, আমদানি করা মূল্যস্ফীতি ছাড়া আরও গোপন কারণ রয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে। কাঁচামালের মূল্য ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আবার কাঁচামালের মূল্য কিছুটা হ্রাস পেলেও পণ্যের মূল্য কেন কমে না। তার কারণ ও কারসাজি কী, সেটাও উদঘাটন হওয়া দরকার।
দুর্নীতি, দুঃশাসনের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল বলেই মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল। সরকার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে কিন্তু সিন্ডিকেট কি লোভ ত্যাগ করেছে? প্রতিদিন পত্রিকায় আসছে গত সরকারের আমলে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটগুলো কী পরিমাণ টাকা লুটপাট ও পাচার করেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফার জন্য পুঁজিপতিরা সব করতে পারে। উপদেশ দিয়ে লোভ ও লুণ্ঠন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জনগণকে সান্ত্বনা দিয়েও তাদের আর্তনাদ থামানো যাবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। গণ-অভ্যুত্থানের পর শ্রীলঙ্কা দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরুক সরকার। এমন প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের পথটাও নির্ধারণ করা দরকার।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক