ডেস্ক রিপোর্ট

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ণ

সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা এবং দায়

আপডেট টাইম : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪ ১১:০৮ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন :

পরিস্থিতি যখন স্বস্তি দেয় না তখন মানুষ পরিবর্তন চায়। এই চাওয়াটাই গতিশীলতা। কিন্তু সব গতিশীলতাই আবার প্রগতিশীলতা নয়। সে কারণেই সব পরিবর্তন ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে না। পরিবর্তনের মধ্যে তাই মানুষের আকাক্সক্ষা থাকে অতীতের চাইতে ভালো থাকবে সে। যদি তা না হয় তাহলে অতীতে ফিরে যেতে পারে না। কিন্তু বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ মনে মনে ভাবে, আগেই ভালো ছিলাম। যদি জিজ্ঞেস করা হয় কী কী কারণে আগে ভালো ছিলেন? তাহলে সব কথা গুছিয়ে বা বুঝিয়ে বলতে হয়তো পারে না, কিন্তু মুখের ভাবে মনের কথা প্রকাশ করে যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে আগে একটু স্বস্তিতে ছিলাম। টাকা বেশি ছিল না কিন্তু মোটামুটিভাবে চলতে পারতাম। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় আগে কি মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারতেন? তখন একটু মুচকি হেসে বলবেন, তা অবশ্য না। এটা বলেই আবার বলবেন, মোবাইল ফোন তো খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনি করে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পরিবহন সব ক্ষেত্রেই একই কথা বলবেন। সমাজ আধুনিক হয়েছে, কিন্তু আমি তো আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছি। আসলে প্রশ্নটা এখানে, সমস্যা এটাই এবং সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই। তা না হলে উন্নয়নের নিদর্শন দেখিয়েও মানুষকে সন্তুষ্ট করা দুরূহ। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ আর দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে তাই রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংস্কারের আকাক্সক্ষা তীব্র হয়েছে। দেশের উৎপাদন বাড়ছে, মাথাপিছু আয় খাতাকলমে বাড়ছে, জিডিপিও বাড়ছে কিন্তু এটা তো সত্যি যে, মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্যও বেরে যাচ্ছে। একদল মানুষের এত সম্পদ যে তারা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে তৈরি হয়েছে এক অনিরসনযোগ্য সংকট। ফলে মানুষের ক্ষোভের একটা কারণ হলো, লাগামহীন সম্পদ পাচার। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রামে তাই সেøাগান উঠেছিল, দেশের সম্পদ পাচারকারীদের বিচার চাই। অতীতে মানুষ প্রতিদিন পত্রিকায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতির কাহিনি পড়তে চায়নি। জনগণের সম্পদের লুণ্ঠন প্রতিরোধ করার দায়িত্ব মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ-বিচারকের। কিন্তু তারা সেটা করেননি। বরং তাদের লুণ্ঠনের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা দেখে মানুষ আঁতকে উঠেছে। রাগে ফুঁসে উঠেছে। ফলে এদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা যেমন ভেবেছে, তেমনি আইনি উপায় দেখতে চেয়েছে মানুষ। প্রজাতন্ত্রের নামে মানুষকে প্রজা বানিয়ে রাখার ব্যবস্থা এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, মানুষ ভুলেই গিয়েছিল সে স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীন ব্যক্তির মর্যাদা পায়নি মানুষ। বলা হতো, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন স্বাধীন। আর মানুষ ভাবে শুধু সেই পরাধীন। ফলাও করে বলা হয়, ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। কিন্তু কার্যত ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ মালিক হিসেবে দেখেছে ক্ষমতাসীনদের। এমন এক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ কাউকে একজন বিশেষ ব্যক্তির কাছেই কেবল জবাবদিহি করতে হতো। আর সেই ব্যক্তি ছিলেন সমস্ত জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এরই অবসান চেয়েছিল ছাত্র-জনতা।

‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ বলতে বলতে আইনের মারপ্যাঁচে সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ চলেছে। চূড়ান্ত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনও আইনসংগত ও বৈধ বলে বিবেচিত হয়েছে। এ রকম বৈধ নির্বাচন (!) তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনতার কোনো সংযোগ তৈরি করে না, বরং পুরনো সংযোগও ছিঁড়ে ফেলে। এসব নির্বাচন গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে আর মানুষের বিশেষত যুবসমাজের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে। ক্ষমতায় থাকলে কোনো কিছুই অন্যায় নয়, এই মানসিকতার বিস্তার ঘটিয়েছে। তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা ভাবতে শুরু করেছিলেন, এ রকমভাবে নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন কমিশনের ছত্রচ্ছায়ায় বৈধভাবে অবৈধ ক্ষমতা বছরের পর বছর ভোগ করতে থাকবেন। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। তারা জনগণের ভোটের উৎসাহকে ধ্বংস করেছে, জনগণও ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছিলেন দিন দিন। নির্বাচন কমিশন শুধু আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে চায়নি বরং উৎসাহের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের মনের আশা পূরণে ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন করা যাবে, এমন ভাবনা মানুষ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়বে না কোনোভাবেই, এই ধারণা মোটামুটি স্থায়ী হয়ে পড়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের তাই বিকল্প ছিল না। একই সঙ্গে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না গণরোষে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে শাসকরা অত্যাচারী হলে, জনগণের সমর্থন হারালে ক্ষমতার পটপরিবর্তন কি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বারবার হতে হবে? জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের কোনো পথ কি তৈরি হবে না? ‘ভোটের ক্ষমতা’ প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কি জনগণের হাতে আসবে না? এবারের অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত প্রশ্ন এটাই। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্রের সব স্তরের নির্বাহীরা পরিচালিত হন। তাই তাদের অবশ্যই এক ব্যক্তির বদলে জনগণের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি কিংবা সংসদীয় পদ্ধতি যাই হোক না কেন, প্রধান বিষয় হলো, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা। এই লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রয়োগটাই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা প্রধানত শাসনতান্ত্রিক আইনে, সুতরাং আইনের সংস্কার জরুরি। ক্ষমতায় থেকে কেউ-ই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন এসেছিল। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক কোনো ব্যবস্থা নেই, যে কারণেই ক্ষমতাসীনদের অধীনে পাঁচ বছর পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে জাতীয় টেনশন ও গণতন্ত্রের নির্বাসন দেখেছে দেশের জনগণ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইলেও বিশেষ কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে। তারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায়নি বরং শাসনব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা রাজপথে লিখেছিল রাষ্ট্র সংস্কার চলছে, সে সময় হেলমেট বাহিনী দিয়ে তা দমন করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই কথা মানুষের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছিল। এবারের আন্দোলনেও তারা বারবার সংস্কারের কথা বলেছে। ছাত্রদের এই দাবির সঙ্গে দেশের সচেতন মহল দাবি তুলেছে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে ধরনের সংস্কার করতে হবে তাতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের বিশেষ একজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্র্তৃত্বের অবসান করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নে এবং স্থানীয় সরকারের উন্নয়নকাজে পৃথক ভূমিকা নিশ্চিত করা, জাতীয় বাজেট প্রণয়নে জন-অংশগ্রহণ বাড়াতে সংবিধানের ৮০-৯২ অনুচ্ছেদের সংস্কার এবং বিশেষভাবে ভোটব্যবস্থার এমন এক সংস্কার, যাতে ভোট অনুযায়ী আসনের হিস্যা নির্ধারিত হয় অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা যায়। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে নির্বাচিত ঘোষণা করে অন্য প্রার্থীর সমর্থক ভোটারদের রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের ভোটকে মূল্যহীন বানানোর অবসান দরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা সংশোধন হলে প্রতিটি মানুষ ভাবতে পারবে যে, জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তার মতেরও মূল্য আছে।

এই ভূখণ্ডের জনগণের যেকোনো গণ-আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা দমনকারী বাহিনী হিসেবেই দেখে এসেছে জনগণ। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর যে উদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল ব্রিটিশ, পাকিস্তান বিদায় হলেও সেই উদ্দেশ্য এখনো বহাল রয়েছে। অর্থাৎ শাসকদের পাহারাদার হিসেবে কাজ করা, বিরোধী দল এবং মতকে দমন করা, জনগণের সামনে ভয়ের প্রতিমূর্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যেন পুলিশের কাজ। ফলে স্বাধীন দেশেও পুলিশের মানসিকতা এবং জনগণের পুলিশের প্রতি মনোভাব পাল্টায়নি। এখনো পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয়, ক্ষমতাসীন দলের বাহিনী। আর দমন-পীড়নের বাহিনী এমন ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির অবাধ সুযোগ বিষয়টি। পুলিশের চাকরি প্রত্যাশীদের বেশিরভাগেরই আকাক্সক্ষা জনগণের সেবক হওয়া নয় বরং বেতনবহির্ভূত রোজগার এবং বিধিবহির্ভূত ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। এর জলন্ত প্রমাণ বিগত ১৫ বছরে পুলিশের বড় কর্তাদের সম্পদ ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ। বিগত আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে ঔপনিবেশিক শাসনামলের পুলিশ অ্যাক্ট, পরবর্তীকালের মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোরও জনতার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সংস্কার প্রয়োজন। ফলে নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার, প্রশাসনে সংস্কার, পুলিশে সংস্কার সবকিছু কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার ওপর।

কিন্তু বড় কথা হলো এসব সংস্কার করবে কে? সংস্কারের আকাক্সক্ষা জনগণের আছে। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা পালন করতে হবে। জনপ্রতিনিধি যারা হবেন তারা যদি জন-আকাক্সক্ষা ধারণ না করেন বা জন-আকাক্সক্ষার বিপরীতে চলতে থাকেন তাহলে মানুষ প্রতারিত বোধ করবেন আবার। ধনীদের দ্বারা, ধনীদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে ধনীদেরই স্বার্থরক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক। যদি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তারা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি না থাকলে সাধারণ মানুষের কথা কে বলবে? সমাজের নানা বিষয়ে সংস্কার, পরিবর্তন বা আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ বিপ্লবের স্বপ্ন তুলে ধরে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, আন্দোলনে নামে। ফলে জনগণের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার না হয় তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন