ডেস্ক রিপোর্ট
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২:১৪ অপরাহ্ণ
আবু নাসের অনীক :
‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারটির প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে নতুন একটি প্লাটফর্ম গঠন করা হয়েছে। এই প্লাটাফর্মটির চূড়ান্ত গন্তব্য রাজনৈতিক দল গঠন বলেই তারা জানিয়েছেন। সেই গন্তব্যে পৌছানোর জন্য এটি প্রাথমিক পদক্ষেপ।
এই কমিটির সদস্য সচিব বলেন,“এটা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম, তবে এখনই রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা যাত্রা শুরু করছি না। দল হিসেবে কার্যক্রম কবে কিংবা কিভাবে হবে সেটা ভবিষ্যতের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে”।
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী যিনি এবি পার্টির সহকারী তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন; আখতার হোসেন যিনি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’ এর আহ্বায়ক ছিলেন। সরকারের দুজন ছাত্র উপদেষ্টাও ছাত্র শক্তির নেতা।
আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে আপামর ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করলেও এটি ধীরে ধীরে একটি পক্ষভূক্ত হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্লাটফর্ম বলেন অথবা রাজনৈতিক দল যেকেউ গঠন করতে পারেন। সেটা তার নাগরিক অধিকার।
সমস্যাটা সেখানে যখন আপনি একটি সফল গণঅভ্যূত্থানকে নিদির্ষ্ট একটি অংশে ক্যাপিটালাইজ করে কাজটি করবেন। সমস্যা তখনই যখন আপনি সরকারে থেকে এই কাজটি পরিচালনা করবেন। তখন সেটা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হয়ে যাবে।
‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এই প্লাটফর্মটিকে ক্যাপিটালাইজ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্র শক্তির নেতৃত্ব সরকারে অংশগ্রহণ করে সরকারী পৃষ্টপোষকতায় দল গঠন স্পষ্টতই ‘স্বার্থগত সংঘাত’ সৃষ্টি করছে।
‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এই ব্যানারটির নিচে হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্য নিয়ে। একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে।
এই ব্যানারটিকে নতুন দল গঠনের ম্যান্ডেট কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা আপনাদেরকে দেয় নাই। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও জেলায় যখন ট্যুর করছেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা, তখন সাধারণ ছাত্ররা কিন্তু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে আপনাদের অধিকার নিয়ে।
প্রাথমিকভাবে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ করেছেন। আপনাদের বিবেচনায় বিশিষ্ট নাগরিকদের (৫৫ জন) সাথে পরিচিত হলাম। যদিও এদের একটা বড় অংশকে পূর্ব থেকেই চিনি। যাদের মধ্যে প্রধান তিন নেতৃত্বসহ অধিকাংশই গত ৩/৪ বছরের মধ্যে নূন্যতম ২/৩ টি প্লাটফর্ম পরিবর্তন করেছেন। এটা উল্লেখ করলাম এজন্য যে, আদর্শিক অবস্থান দোদুল্যমান থাকলে এমনটি ঘটে।
নাগরিকদের মধ্যে ফেসবুক ইনফ্লুয়েন্সার আছেন কয়েকজন। যার মধ্যে একজন বাংলাদেশে মেটার পাবলিক পলিসি প্রধান আছেন। আমি জানিনা মেটার, নীতিমালা এটা এডমিট করে কি না তার প্রতিনিধি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারেন কি না। কারণ এটাও একটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এর আওতায় পড়ে স্বাভাবিক ভাবেই।
কৃষক-শ্রমিক এদেরকে হয়তো আপনারা নাগরিক হিসাবে গণ্য করেন নাই। অথচ এই গণঅভ্যূত্থানে সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। এই নাগরিক কমিটি দিয়ে আপনারা বিদ্যমান সংবিধান পাল্টানোর জন্য গণপরিষদ গঠনের আওয়াজ তুলছেন।
যে কমিটিতে দেশের সকল স্তরের নাগরিকের উপস্থিতি আপনারা নিশ্চিত করতে পারছেন না সেই কমিটি দিয়ে সংবিধান সংশোধন করার প্রস্তাবনা রাখতে চাইছেন।
এত যে ‘ইনক্লুসিভনেস’ এর কথা বলছেন, সেটার সাথে তো আপনাদের ব্যবহারিক কাজের মিল খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছে না।
নতুন দল গঠনের পূর্বেই তাদের পক্ষে কিছু এনজিও সামাজিক সম্মতি উৎপাদনের লক্ষ্যে নিজ দায়িত্বে নেমে পড়েছেন। তারা সাধারণ জনগণের চিন্তাকে প্রভাবিত করছেন। এই ম্যানুপুলেট পথে এগিয়ে ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব না।
দল গঠনের জন্য আপনারা জেলায় জেলায় সফর করবেন। আর সরকার তার নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে তাদের প্রটোকল দেওয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এইটা কেমনে সম্ভব সরকারের পক্ষ থেকে?
আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের বাইরে ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীরা সংগঠিতভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। জীবন দিয়েছেন। তাদের অংশগ্রহণ ব্যতীত চূড়ান্তভাবে এই গণঅভ্যূত্থান সফল হওয়া সম্ভব ছিলো না।
তাহলে প্রটোকল দেওয়ার সময় শুধুমাত্র ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কেন? এটা তো একটা জলজ্যান্ত বৈষম্য। এটা তো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের চেতনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এজন্য কি অকাতরে মানুষ জীবন দিলো?
আমাদের ট্যাক্সের টাকায় আপনারা দেশ ঘুরবেন; ডিসি-এসপি’র প্রটোকল নিবেন এই ম্যান্ডেট তো দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা আপনাদেরকে দিইনি।
সফর করবেন, দল গঠন করবেন খুবই ভালো কথা। সেটা আপনাদের টাকায় আপনারা করুন। কেউ বাধা দিতে আসবেনা; এটা নিয়ে কেউ সমালোচনাও করবে না। কিন্তু সরকারের এক টাকাও ব্যবহার করে এটা করা যাবে না।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। দেশটা কি আপনারা চালাচ্ছেন না কি ছাত্র সমন্বয়করা? সাংবিধানিকভাবে শপথ নেওয়া একটি সরকারের প্যারালালি আর একটা সরকার পরিচালিত হচ্ছে।
আবার সেই সরকারের সকল ধরণের খরচ মেটাচ্ছেন আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেওয়া সরকার! বাহ! কি চমৎকার ব্যবস্থাপনা। এইটার লেজিটিমেসি আপনাদেরকে কে দিলো?
এটা যদি বন্ধ করা না হয় এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এমনকি দেশ গৃহযুদ্ধের দিকেও যেতে পারে। ইতিহাস পাঠ করুন এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। এখনও সময় আছে এর লাগাম টেনে ধরুন।
বন্যা পরিস্থিতিতে গণত্রানের জন্য জনগণ আপনাদেরকে কয়েক কোটি টাকা প্রদান করলো। সেইসময়ে প্রতিদিন ক্ষণে ক্ষণে আপডেট দিলেন কতো টাকা সংগ্রহ হচ্ছে। সেই অর্থ ব্যয়ের হিসাব কিন্তু এখন পর্যন্ত জনগণের সামনে দিতে পারেন নাই। দেওয়াটা কি উচিত ছিলো না?
বুঝতে পারতেছিনা এত এত রক্ত ঝরিয়ে যে ফ্যাসিস্টকে বিদায় করা হলো ঘুরে-ফিরে আপনারা একই আচরণ কেন করছেন? শহীদদের স্মরণে স্মরণসভা করবেন তার জন্য বাজেট পাঁচ কোটি টাকা!! অবিশ্বাস্য সব বিষয় ঘটাচ্ছেন।
যে শহীদ মিনার থেকে এক দফার দাবী উঠেছিলো সেখানেই স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের অংশগ্রহণে শহীদদের স্মরণ করা যেতে পারতো। লাখো মানুষ সমবেত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতো। সেটা চলে গেল চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের এসি অডিটোরিয়ামে নির্দিষ্ট অতিথিদেরকে নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে। যা আন্দোলনের মূল চেতনার পরিপন্থী!
আন্দোলনে আহত চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে না পেরে নিজের সদ্যজাত সন্তান বিক্রি করার মতো অমানাবিক ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা তাদের আগামী চিকিৎসা ব্যয় মেটাবেন কিভাবে তার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে মিনতি জানাচ্ছেন।
গণমাধ্যম তার পূর্বের ভূমিকায় ফিরে গেছে। নিজেরাই নিজেদেরকে সেল্ফ সেন্সর করছেন। বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের যেভাবে সেবা করেছেন এখনও তারা বর্তমানে একই ধরণের পারপার্স সার্ভ করছেন। স্বাধীন ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
গণঅভ্যুত্থানের জণআকাঙ্খা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার। সরকারের প্রধান ম্যান্ডেট হওয়া উচিত সেই কাজকে এগিয়ে নেওয়া। গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে তাদের রুপরেখা ইতিমধ্যেই উপস্থাপন করলেও সেগুলি সরকার আমলে নিচ্ছেন না।
পথ নিদির্ষ্ট; গন্তব্যও নিদির্ষ্ট। কিন্তু সরকার সেই নিদির্ষ্ট পথে হাটছেন না। পথ ভুলের পরিণতিতে চোখের সামনে কিভাবে ফ্যাসিস্ট জন্ম নেয় সেই উদাহরণও জলজ্যান্ত হয়ে আছে।
আপনাদের এধরনের কর্মকান্ড পতিত ফ্যাসিস্টের পক্ষে সামাজিক সম্মতি উৎপাদন করছে এটা কি বুঝতে পারছেন না? অন্যদিকে সারাক্ষণ প্রতি বিপ্লবের জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন সাধারণ জনগণকে।
আমাদের সাধারণ নাগরিক এর প্রত্যাশা আপনারা সঠিক পথে হেটে দেশটিকে তার কাঙ্খিত গন্তব্যে নিয়ে যাবেন। অনুরোধ করবো, এটি বুঝুন জণআকাঙ্খা মানে কিন্তু শুধুমাত্র ছাত্রদের আকাঙ্খা নয়।
এই আকাঙ্খার অংশীজন সাধারণ জনগণ; শ্রমজীবী মানুষ। যেই শ্রমজীবী মানুষের সর্বাধিক জীবন উৎসর্গ হয়েছে এই আন্দোলনে। তারা প্রান্তিক মানুষ। গণমাধ্যমে তাদের কথা উচ্চারিত হয় না। তাদের আকাঙ্খাকে আমলে নিন।
লেখক: জনস্বাস্থ্যবিদ।