ডেস্ক রিপোর্ট

১৮ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

রক্তস্রোতে গণতন্ত্রের আশা

আপডেট টাইম : আগস্ট ১৮, ২০২৪ ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন :

অত্যাচার, অহমিকা আর অপমান মানুষকে কতখানি ক্ষুব্ধ করে এবং রাজনীতি মানুষের জীবনকে কতভাবে যে প্রভাবিত করে, বাংলাদেশের মানুষ আবার তা দেখল। কট্টর রাজনীতিবিমুখ মানুষও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ এ দেশ আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ। এ দেশের মতো এত রাজনৈতিক আলোচনায় আগ্রহী মানুষ পৃথিবীতে খুব কম দেশেই আছে। কিন্তু জুলাই থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঝড় বয়ে গেল, তা বাংলাদেশে তো বটেই, এই উপমহাদেশের মানুষ কখনো দেখেনি। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের এ এক নতুন নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। মৃত্যু, রক্ত আর কান্না মিশিয়ে এত সাহস আর দ্রোহ দেখেনি মানুষ আগে।

গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন ৫ আগস্ট। ক্ষমতায় টিকে থাকতে ৫ আগস্ট এবং তার পরদিন পর্যন্ত দেশে যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তা স্বাধীনতার পর ৫ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরবর্তী বিক্ষোভ ও সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ২১৭ জন নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছিল। ৩২৬ জন নিহত হন ৪ থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে। ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে ৭ থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে। মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪ থেকে ৬ আগস্ট সময়ে নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন অন্তত ৮৭ জন। পুলিশ সদস্য রয়েছেন ৩৬ জন। বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার সদস্য রয়েছেন একজন করে। আন্দোলনে পুলিশ সদস্যদের মৃত্যু এই ভূখণ্ডে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক। এই ৪২ জনের মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য র‌্যাবে নিয়োজিত ছিলেন। ৪ থেকে ৬ আগস্ট সময়ে নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থী। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়তেন। এ সময়ে নিহতদের মধ্যে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ১২ জন নেতা, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। ৩২৬ জনের মধ্যে বাকি ১৬৮ জনের সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই অথবা জানা যায়নি। আর ৪২ জনের পরিচয়ই এখনো নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। পুলিশের গুলি ও সংঘর্ষে আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত মৃত্যু দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ছাত্র শ্রমিক জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগের পরিস্থিতিতে ৮ আগস্ট রাত ৯টা ১৫ মিনিটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে। এই সরকারের সামনে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। তা উপেক্ষা করা বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। চ্যালেঞ্জগুলোর কিছু এখনই, কিছু স্বল্পমেয়াদেএবং কিছু দীর্ঘমেয়াদে মোকাবিলা করতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব কাজ করা সময়ের দাবি।

গত পনেরো বছরে রাজনৈতিক কর্র্তৃত্বের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের পুলিশ ও প্রশাসনের শৃঙ্খলা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যে রাষ্ট্রীয় এবং এখানে কর্মরতরা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তা ভুলিয়ে দিয়ে দলীয় কর্মীর মতো ভূমিকা আর দুর্নীতির অবাধ সুযোগের কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দুই প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক সমাজের একটা বড় অংশকে এতটা অনৈতিক কাজে যুক্ত করা হয়েছিল, যার অতীত নজির নেই। প্রশাসনিক দায়িত্ব, সরকারের নির্দেশ মানতে গিয়ে মানবিক মূল্যবোধের যে অধঃপতন ঘটেছে সেখান থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতেই হবে যে, যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল না হয় তাহলে সংঘাত অনিবার্য। এই সংঘাত রাজনৈতিক রূপ নেবে। যদি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন হয়, তাহলে যে সাময়িক শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা তৈরি তৈরি হয় সেই সময় এক ধরনের অরাজকতা চলে। আর এ সময়ে তাৎক্ষণিক সুবিধা নেওয়া, শত্রুতা, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, জমি, বাড়ি, সম্পদ দখল করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। এসব যারা করে সেই মানুষগুলোর কোনো সামাজিক দায় নেই, থাকে না কোনো লজ্জা বা কোনো মানবিকবোধ। কাজেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা, দখলবাজি বন্ধ করা, দেশকে আইনশৃঙ্খলার আওতায় নিয়ে আসার কাজটি প্রথম এবং প্রধান। দ্বিতীয় কাজটি হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত বাজারের কারণে। চাহিদা-সরবরাহের সাধারণ নীতিকে পর্যুদস্ত করে বাজার সিন্ডিকেট সরবরাহ চেনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং দ্রব্যমূল্য সহনীয় করে সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আনা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আর একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের চর্চা এবং জবাবদিহিতা না থাকায় গত পনেরো বছর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমন দলীয়ভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছিল, যা আগে কখনো হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহ দুর্নীতি এবং দমনপীড়নের সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। যোগ্যরা বিতাড়িত অথবা মাথা নিচু করে থেকেছে আর দলীয় ব্যক্তিরা দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিল। লুটপাট হয়েছে সীমাহীন। ফলে সব রকম সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। পুলিশ এবং প্রশাসন তো বটেই, বিচার বিভাগও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বলা হয় বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু মানুষ দেখেছে আওয়ামী লীগের অধীনে স্বাধীন। আওয়ামী লীগ যেভাবে চেয়েছে, বিচারকাজ সেভাবেই চলেছে। কাউকে জামিন দেওয়া বা শাস্তি দেওয়া ক্ষমতাসীন দলের অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভর করত। ফলে এখানে বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে আসা অপরিহার্য। তা না হলে মানুষের আস্থা ফিরবে না। দেশে প্রশাসন বলতে মানুষ বুঝেছে দলীয় শাসন চালাবার সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেটা সব সরকারের আমলেই কমবেশি ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ শাসনমলে আমলাদের মনোভাবের নিম্নমুখী পরিবর্তন ঘটেছিল। আগে আমলাদের বৈশিষ্ট্য ছিল তারা যখন যে সরকার থাকত তখন সেই সরকারের অনুগত থেকে কাজ করতেন এবং নানা ধরনের ব্যক্তিগত সুবিধা নিতেন। কিন্তু গত ১৫ বছরে তা পাল্টে গিয়ে আমলারা নিজেরাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা। ফলে প্রশাসনিক লাঠিয়াল হিসেবে তারা যেমন নিপীড়ন করেছেন, তেমনি দুর্নীতি করেছেন অবাধে। ফলে এখানে সংস্কার ছাড়া ভবিষ্যতেও কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কাজ করতে পারবে না। প্রশাসনকে এটা মানতে বাধ্য করতে হবে যে, তারা কোনো দলের নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং জনগণের সেবা প্রদানই তাদের কাজ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লুটপাট অনিবার্য বিষয়, এটা সবাই মানে। কিন্তু গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে লুটপাট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে অর্থ পাচারের মাধ্যমে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বিশ্বের সব দেশের আর্থিক অবৈধ লেনদেন নিয়ে গবেষণা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। তুলনা করে দেখুন, পদ্মা সেতু নির্মাণে এগারো বছরে ব্যয় হয়েছে ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার। আর একটি উদাহরণ, আওয়ামী লীগ সরকার আইএমএফের সঙ্গে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণচুক্তি সম্পাদন করে। সাত কিস্তিতে আইএমএফ এই ঋণ দেবে। বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার শর্তসাপেক্ষ ঋণ নেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচার রোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট শুধু কেটে যাবে তাই নয় বরং অনেক শক্তিশালী হবে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে নির্বিচারে লুটপাট চলেছে। ফলে এ খাত আজ বিপর্যস্ত, ভঙ্গুর। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়ার ফলে ব্যাংক খাত দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে রুগ্্ণ বানিয়ে ফেলা হয়েছে, ঋণ নিয়ে শোধ না দেওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল, ফলে সরকারি হিসাব মতেই আজ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকৃত হিসাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার কম নয়। এই অনাচার বন্ধ এবং খেলাপি হওয়া অর্থ উদ্ধার করে সাধারণ মানুষের ব্যাংক আমানতের নিরাপত্তা দিতে হবে।

বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্রয়প্রাপ্ত বিষয় ছিল দুর্নীতি। মেগা প্রকল্প, নিয়োগ, প্রমোশন, বদলি, নির্মাণ ও কেনাকাটার মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব খাত এবং গ্রামের হাটবাজারের ইজারা থেকে শুরু করে সচিবালয়ে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য এবং বেপরোয়া। উচ্চপদের বেনজীর-মতিউর থেকে নিম্নপদের আবেদ আলীরাই শুধু নয়, প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতার সঙ্গে দুর্নীতির এই মেলবন্ধন ছিন্ন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন দরকার। তেমনি দরকার দুর্নীতির কাঠামোগত পথ বন্ধ করা। দুর্নীতির রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ দেশের মানুষের নানা কষ্ট। ভাতের কষ্ট, বাসস্থানের কষ্ট, শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ পাওয়ার কষ্ট কিন্তু সব ছাপিয়ে মুখ ফুটে কথা বলতে না পারার কষ্ট যেন প্রধান হয়ে উঠেছে। ভোট দিতে না পারার কষ্টের সঙ্গে ভুয়া ভোটে বিজয়ীদের দম্ভ মানুষকে চূড়ান্তভাবে অপমান করেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতার পালাবদলের চেয়ে পছন্দ করেছিলেন ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে প্রহসনমূলক নির্বাচনের ফলে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা আস্থা হারিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে সংস্কার দরকার এখানেও। গণ-অভ্যুত্থানের আগে মানুষ চেয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন, এখন চায় ব্যবস্থার পরিবর্তন। জীবন ও রক্ত দিয়ে হাসিনা সরকারের শাসন উচ্ছেদ করা হয়েছে, এখন মানুষ দেখতে চায় গণতান্ত্রিক শাসন।

লেখক: সহকারি সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন