ডেস্ক রিপোর্ট

১৮ আগস্ট ২০২৪, ৯:২৫ অপরাহ্ণ

বিজয় মিছিল থেকে বাড়িতে ফিরল আল আমিনের নিথর মরদেহ

আপডেট টাইম : আগস্ট ১৮, ২০২৪ ৯:২৫ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

অধিকার ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মীর মুহাম্মদ আল আমিন। বিজয় উল্লাসকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে করছিলেন লাইভ। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তার নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর কোথাও আল আমিনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজয় মিছিলের ১২ দিন পরে বুলেটের ক্ষতচিহ্নসহ তার মরদেহ পাওয়া যায় রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। বিজয় মিছিলে আমার ভাই এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে, তা কল্পনাও করিনি। কথাগুলো ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন আল আমিনের ছোটবোন আফলান সিনথিয়া।

নিহত মীর মুহাম্মদ আল আমিন (২৯) শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিঝারি ইউনিয়নের দক্ষিণ মগর গ্রামের ইসমাইল মীর মালতের বড় ছেলে। বিজয় মিছিল থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না আল আমিনের স্বজন ও তার সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারীরা।

আল আমিনের বোন আফলান সিনথিয়া বলেন, আমার ভাই চার বছর বয়স থেকে পরিবারের সঙ্গে সৌদি আরব থাকতেন। পরিবারের সবাই এক বছর আগে বাংলাদেশে ফিরলেও আল আমিন এসেছিল চার মাস আগে। দেশে আসার পরে রাজধানী ঢাকার সাভার বাইপাল এলাকায় বাবাকে নিয়ে একটি মুদি দোকান পরিচালনা করতো সে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিল আল আমিন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দুপুরের দিকে আল আমিন বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করে তার নিজের ফেসবুক আইডিতে বিজয় উল্লাস লাইভ করেন। যা তার স্বজনরাসহ সবাই দেখেছেন।

তিনি বলেন, আমার ভাই আল আমিনের বিজয় মিছিলে করা লাইভটি ছিল ছয় মিনিট ২৭ সেকেন্ডের। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষ স্লোগান দিচ্ছে, ‘পালাইছেরে পালাইছে, শেখ হাসিনা পালাইছে’। অন্যদিকে অনেক মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে যাচ্ছিল। ভিডিওতে আরও দেখেছি, ভ্যানে করে আহত অথবা নিহতদের নেওয়া হচ্ছে। এর কিছু সময় পরে আমার ভাই আল আমিনের ফেসবুক লাইভটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে তার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর থেকে সে নিখোঁজ ছিল।

তিনি আরও বলেন, আল আমিনের সঙ্গে ঢাকাতে আমার বাবা ও আরও এক ভাই থাকতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় প্রথমে আমাকে তারা জানায়, আল আমিন এখনো বাসায় ফেরেনি। দ্বিতীয় দফায় রাত আড়াইটার দিকে বাবা আমাকে একই সংবাদ আবারও বলেন। এরপর আমরা খবর নিয়ে জানতে পারি ৫ তারিখে সাভার, বাইপাল, নবীনগর এলাকায় অনেক বেশি গোলাগুলি হয়েছে। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে ঢাকার সাভার এলাকার এনাম মেডিকেল, হাবিব মেডিকেল, গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল, শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি থাকা আহতদের মধ্যে খোঁজ করে কোথাও আল আমিনের সন্ধান পাইনি। এরপর আমরা সেনাবাহিনী, র‌্যাবের কাছেও গিয়েছিলাম, তারাও কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। ভাইর এমন নিখোঁজ সংবাদে আমাদের পুরো পরিবার পাগলপ্রায় হয়ে যায়।

বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে সহদোর ভাই হারানোর শোকে কাতর আফলান সিনথিয়া আরও বলেন, হঠাৎ বেসরকারি একটি টেলিভিশনে সংবাদ দেখতে পাই সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চারটি অজ্ঞাত মরদেহ রয়েছে। নিখোঁজের ১২ দিন পর গতকাল ১৭ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে খবর নিয়ে কপালে বুলেটের চিহ্নের ক্ষতসহ আমার ভাই আল আমিনের মরদেহ খুঁজে পাই। হাসপাতাল সূত্রে জানতে পেরেছি, ৬ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই মারা গেছে।

তিনি আরও বলেন, শনিবার (১৭ আগস্ট) রাতেই আল আমিনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। রাতে গ্রামের বাড়িতে জানাজার নামাজ হয়েছে। এরপর রাত ৩টার দিকে শরীয়তপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীসহ অন্যান্যরা আল আমিনের মরদেহ শরীয়তপুর শহরে নিয়ে এসে হাসপাতালের মর্গে রাখেন।

ঢাকা পোস্ট আফলান সিনথিয়ার কাছে জানতে চায়, এখন আপনার পরিবার কী চায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই। তাকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। এ ছাড়াও এমন কিছু করা হোক, যাতে প্রজন্ম আমার ভাইকে মনে রাখে।

অন্যদিকে রোববার (১৮ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা আল আমিনের বোন আফলান সিনথিয়াকে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন আহাম্মেদ ও পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলমের সঙ্গে সভা করেন। সভায় আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সম্মান ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়।

এ সময় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে জানান, বিকেলে নড়িয়া উপজেলার পঞ্চপল্লী গুরু-রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আল আমিনের রুহের মাখফিরাত কামনায় অনুষ্ঠিতব্য জানাজা নামাজে তারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়াও তারা বলেন, বর্তমান সরকারের নির্দেশনা রয়েছে, নিহত-আহতদের আর্থিক সহযোগিতাসহ অন্যান্য সহযোগিতা করা হবে। তাই, আল আমিনের পরিবারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত লিখিত পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।

শরীয়তপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক আমিন মোহাম্মদ জিতু। তিনি বলেন, আমরা চাই মীর মুহাম্মদ আল আমিনকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সহিত সমাহিত করা হোক। এ ছাড়াও ক্ষতিপূরণসহ তার নামে জেলার কিছু একটার নামকরণ করা হোক। যাতে আগামী প্রজন্ম আল আমিনের এই আত্মদানের কথা চিরদিন মনে রাখে।

শেয়ার করুন