ডেস্ক রিপোর্ট
১৮ মে ২০২৪, ১১:৪০ অপরাহ্ণ
বেদানন্দ ভট্টাচার্য:
তারাপুর চা বাগান একটি দেবোত্তর সম্পত্তি। একজন ধর্মপ্রাণ মানবহিতৈষী ব্যক্তি তাঁর বিশ্বাস এবং জনকল্যাণের প্রনোদনায় বি.সি.গুপ্ত ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন ও ২,৯০,০০০/- (দুই লক্ষ নব্বই হাজার) টাকার প্রমিসরি নোট ঐ ট্রাস্টে হস্তান্তর করে তার লভ্যাংশ থেকে তারাপুর চা বাগানে স্থাপিত শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতার সেবাপূজার ব্যবস্থা করেন। ঐ ট্রাস্টের আয় দ্বারা সেবাপূজার কাজ পরিচালনায় খামতি হবে-এরূপ ধারণায় তিনি পরবর্তীকালে ১৩২২ বাংলার ১৭ আষাঢ় মোতাবেক ১৯১৫ ইংরেজির ২ জুলাই একটি সুচিন্তিত এবং সুলিখিত দানপত্র দ্বারা তারাপুর চা বাগান সহ সিলেট ও কাছাড় জেলার ১৩৮ হাল তথা ৪১৪০ কেদারেরও বেশী জমি শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউর দেবতাকে দান করেন। তার দানপত্র দলিলে সমাজউন্নয়ন ও মানব সেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্ত স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লিখিত আছে। নিজ পরিবার পরিজনের জন্য ‘গ্রাসাচ্ছাদন’ (Subsistence) ছাড়া খুব একটা কিছুর ব্যবস্থা ঐ দলিলে তিনি সন্নিবেশিত করেন নি। মহাপ্রাণ বৈকুন্ঠ গুপ্ত তার সম্পাদিত দানপত্রের শর্ত মোতাবেক রাধাকৃষ্ণ জিউর দেবতার সেবা পূজা পরিচালনার জন্য তার পুত্র রাধালাল গুপ্তকে সেবায়েত নিয়োগ করেন। দানপত্র বর্ণিত সেবায়েত পরম্পরা অনুযায়ী ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঐ সম্পত্তি পরিচালিত হয়ে আসে। তবে মানব উন্নয়ন বা সমাজ কল্যাণে ঐ সম্পত্তি কিংবা তার কোন আয় ব্যবহৃত হয়েছে কী না সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। উল্লিখিত বিসি গুপ্ত এন্ড সন্স ট্রাস্ট এর কোন হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। তবে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ জনিত অনাসৃস্টির ফলে তদানিন্তন কাছাড় জেলার শিলচর শহরে সৃষ্ট ঐ ট্রাস্টের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
১৯৭১ সালে তারাপুর চা বাগানের অনেক শ্রমিক কর্মচারী সহ তৎকালীন সেবায়েত পরিবারের একজন ব্যতিত সকল পুরুষ সদস্যকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যা করে। পরিবারের একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য পঙ্কজ কুমার গুপ্ত তখন নাবালক ছিলেন। ইতোমধ্যে বাগানটি শত্রু সম্পত্তি দাবি করে সরকার দেবতা বিগ্রহকে বেদখল করার চেষ্টা করলে নাবালক সেবায়েত সিলেটের তদানিন্তন সাবজজ দ্বিতীয় আদালতে ১৯৭১ সালের ৫৫ নম্বর স্বত্ব মোকদ্দমা দায়ের করে ডিক্রিপ্রাপ্ত হন। ডিক্রি মূলে ঐ সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় মর্মে ঘোষণা হয়। ইতোমধ্যে নাবালক পঙ্কজ গুপ্ত সাবালক হয়ে সেবায়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে সেবায়েত পরিবারের সকল দায়িত্বশীল পুরুষ সদস্য শহীদ হওয়ার ফলে একটি শোকাবহ এবং বিশৃংঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সদ্য সাবালক মেডিকেল ছাত্র পঙ্কজ গুপ্ত নানা মামলা মোকদ্দমা ও ভূমিখোর স্থানীয় দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতার ফলে বিব্রত, হতভম্ব ও ভীত হয়ে পড়েন। দুর্বৃত্তদের ভয়ে এক পর্যায়ে তাকে বাগান থেকে বেরিয়ে এসে ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। সার্বিক প্রতিকূক্লকতায় অনেকটা দিশেহারা হয়ে পঙ্কজ গুপ্ত তার কতিপয় ‘গণ্যমান্য শুভানুধ্যায়ী’র পরামর্শে ও সক্রিয় সহযোগিতায় তারাপুর বাগান পরিচালনার দায়িত্ব আমমোক্তারনামার মাধ্যমে রাগিব আলীকে প্রদান করে বিদেশ চলে যান। দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত প্রকৃত পক্ষে দেবতা বিগ্রহের কর্মচারী। তিনি কিছু ডেলিগেইটেড ক্ষমতা ভোগ করেন। আইনতঃ ডেলিগেইটেড ক্ষমতা পূণরায় ডেলিগেইট করার কোন সুযোগ ছিল না। যাহোক, রাগীব আলী তারাপুর বেবোত্তর সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশের বৈধ সুযোগ পেয়ে সরকারি মেমো ইত্যাদি জালিয়াতি করে ঐ দেবোত্তর সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং এক পর্যায়ে তার নামে নামজারি করার আবেদন করেন। এতে সরকারের কানে কিছুটা হলেও পানি যায়। বিষয়টি তদন্ত করে রাগীব আলী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুটি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়। ঐ ফৌজদারি মামলার দায় থেকে বাঁচার জন্য রাগীব আলী মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দ্বারস্ত হয়ে এবং অনুকূল আদেশ লাভে সমর্থ হন। সরকার হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে মহামান্য আপিল বিভাগে ২০০৯ ইংরেজি সনের ১৬৩ নম্বর সিভিল আপিল দায়ের করলে সর্বোচ্চ আদালত তারাপুর চা বাগান একটি দেবোত্তর সম্পত্তি এবং রাগীব আলীর দখল সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করে বাগানের ভূমিতে স্থাপিত ‘রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ’ ৬ মাসের মধ্যে অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ প্রদান করেন। রাগীব আলী তা করতে ব্যর্থ হলে জেলা প্রশাসক নিজ উদ্যোগে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তা স্থানান্তর করবেন এবং এ সংক্রান্ত ব্যয় রাগীব আলীর কাছ থেকে আদায় করবেন-উপরন্তু রাগীব আলীর কাছে দেবতা বিগ্রহের প্রাপ্য ৫ কোটি টাকারও বেশী অর্থ ত্বরিৎ দেবতার অনুকূলে আদায় করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ব্যর্থতায় জেলা প্রশাসক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন মর্মে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। রাগীব আলীকে অবিলম্বে বৈধ সেবায়েত পঙ্কজ গুপ্তের কাছে তারাপুর চা বাগানের দখল হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয়া হয়। রাগিব আলীর কাছ থেকে নানাভাবে প্রাপ্ত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়।
এই রায়ের ভিত্তিতে পঙ্কজ গুপ্ত জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বাগানের দখল প্রাপ্ত হন।
মহামান্য আপিল বিভাগের এই রায়ে অসম্মত হয়ে রাগীব আলীর কাছ থেকে নানা প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর সূত্রে বাগানের ভূমিতে বসবাসরত বেআইনি দখলকার, রাগীব আলীর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের ৩ জন ছাত্র এবং ইসকন তিনটি রিভিউ মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলা তিনটি মহামান্য আপিল বিভাগ একত্রে শুনানি করে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে রিভিউ মামলার রায়ে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত আলোচ্য দেবত্তোর সম্পত্তিটি পাবলিক দেবত্তোর হিসেবে সাব্যস্ত করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগ, জেলা বার সমিতি, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধিসহ ১১ জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ কমিটিতে সেবায়েত পরিবারের একজনকে অন্তর্ভূক্ত করার বিধানও যুক্ত আছে। তবে পঙ্কজ গুপ্তকে রাগীব আলীর কুকর্মের সাথে কিছু না কিছু জড়িত মন্তব্য করে সেবায়েত পদ থেকে অপসারণ করা হয়। রাগিব আলীর কাছে দেবতা বিগ্রহের প্রাপ্য ৩,৩০,৭৬,১৭৯/২০ (তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ ছিযাত্তর হাজার একশত উনআশি টাকা বিশ পয়সা) সাব্যস্ত হয়।
জেলা প্রশাসক মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশ অনুযায়ী একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি পঙ্কজ গুপ্তের কাছ থেকে দায়িত্ব সমঝে নেন। পরবর্তীতে আবিস্কৃত হয়, পঙ্কজ গুপ্ত বাগানের দায় দেনা, হিসাব নিকাশ কিংবা ভূ-সম্পত্তি কোন কিছুরই কোন স্পষ্ট চিত্র নতুন কমিটিকে দেননি। বরং, বহু মামলা মোকদ্দমা, ব্যাংকের দেনা ইত্যাদি বিষয় সচেতন ভাবে গোপন করেন। ফলে কমিটি প্রথম দিন থেকেই ঘাটতি তহবিল নিয়ে কাজ শুরু করেন। কমিটির তৎকালীন সম্পাদক শান্তনু দত্ত, সভাপতি অধ্যাপক নারায়ন সাহা, সম্মানিত সদস্য বনদীপ দাস, নিলেন্দু দেব প্রমুখ ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বিপুল অর্থ ঋণ হিসেবে কমিটির তহবিলে দিতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, সিলেট কর্পোরেট শাখা বাগানের নামে চলমান একটি হাইপো ঋণ হিসাবে অর্থ যোগান বন্ধ করে দেন। কমিটির পক্ষ থেকে বার বার তাগিদ দেওয়া স্বত্বেও রাগীব আলীর কাছে প্রাপ্য টাকা আদায়ের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। রাগীব-রাবেয়া হাসপাতাল স্থানান্তর কিংবা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অপরাপর নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসক কোন আগ্রহ দেখান নি। উল্লেখ্য যে, রায় বাস্ত বায়ন মনিটর করার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বের কথা মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখ আছে। ব্যবস্থাপনা কমিটিতে জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তিনি কখনো কোন সভায় উপস্থিত হন নি বা অন্য কোন ভাবে কমিটির কার্যক্রমে আগ্রহ দেখান নি। জেলা জজশিপের প্রতিনিধি হিসাবে সিলেটে তৎকালীন কর্মরত মাননীয় উর্ধ্বতন সহকারী জজ জনাব নির্জন কুমার মিত্র কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতেন এবং তিনি তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তিটি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার বদলির পর জেলা জজের মনোনীত প্রতিনিধি বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা জজ মহোদয় কমিটির কার্যক্রমে খুব একটা যুক্ত থাকতে পারেন নি।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন থেকে তারাপুর বাগানের বিপুল ভূ-সম্পত্তিকে ঘিরে নানা দুর্বৃত্তচক্র সক্রিয় আছে এবং বাগান প্রশাসনের দূর্নীতিবাজ অংশটি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আসছে। বাগানের মূল্যবান ভূমি সাবেক সেবায়েত পঙ্কজ গুপ্তের নির্দেশে নানা ভাবে হস্তান্তরিত হচ্ছে এবং পরিচালনা কমিটির অজ্ঞাতে ঐ সমস্ত বেআইনি হস্তান্তর থেকে মিস্টার পঙ্কজ গুপ্ত লাভবান হচ্ছেন মর্মে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। কমিটির কোন কোন সদস্যের ব্যক্তিগত সূত্র ও অপরাপর অবস্থাগত প্রেক্ষাপটে এসব অভিযোগের সবটাই ভিত্তিহীন এমনটা মনে করা কঠিন। বিষয়টি উপযুক্ত ক্ষমতা সম্পন্ন সরকারি এজেন্সি কর্তৃক তদন্ত হওয়া আবশ্যক।
এই বিপুল সম্পত্তি বেআইনি দখলদার, ভূমিখোর দুর্বৃত্তচক্র ও বাগান প্রশাসনের দূর্নীতিবাজ অংশের কবল থেকে বাগানটি পুরোপুরি চালু করতে পারলে নানা জনকল্যাণ মূলক কাজের উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ আছে। দূর্ভাগ্যের বিষয় জেলা প্রশাসনের উদাসীনতা, ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্ষমতার অভাব ও নানা দুর্বৃত্তচক্র বাগান ব্যবস্থাপনার একাংশের মধ্যকার অসৎ স্বার্থের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের প্রাপ্য মজুরি বেতন ইত্যাদি পাচ্ছেন না। একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তির জনহিতৈষণার উদ্যোগ এভাবে ব্যর্থ হলে তা হবে সমাজের সার্বিক ব্যর্থতা। তাই রাগিব আলীর কাছে বাগানের প্রাপ্য নগদ অর্থ আদায়, হাসপাতাল ও কলেজ স্থানান্তর, বাগানের জমিজমা ও অপরাপর মূল্যবান সম্পত্তি নয়ছয় বন্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় এজেন্সি সমূহের সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়া তা হবার নয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রসঙ্গে উদাসীনতা আইনের শাসন ও সামাজিক শৃংঙ্খলার জন্য একটি মন্দ উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিক