ডেস্ক রিপোর্ট

৩ এপ্রিল ২০২২, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ

‘আত্মহত্যা’: কাঠামোগত হত্যাকান্ড

আপডেট টাইম : এপ্রিল ৩, ২০২২ ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক::
আমরা এক বিভীষিকাময় সময় পার করছি। কালবৈশাখীর ঝড় চারপাশে চাঁপা অন্ধকারের চাঁদরে ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু। দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করছি আমরা। আশ্রয় খুঁজছি; খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ক্ষোভে-দুঃখে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন হিসাবে ‘আত্মহত্যা’ নামক শব্দটির সাথে আলিঙ্গন করছি।

একদিকে উন্নয়নের জোয়ারের সাতকাহন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মুখরোচক বয়ান অন্যদিকে একবছরে ১৪ হাজার ৪৩৬ টি, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালে ঢাকা মহানগরীতে খুন হন ১৬৬ জন। একই বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৬৯৫ জন। যা খুনের তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ফেসবুকে লাইভ করে, দীর্ঘ নোট লিখে ঘটনা ঘটছে। সমাজের মধ্যে অস্থিরতা কতোটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে এগুলো তার বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনাগুলি যেভাবে ঘটছে এগুলি বিশ্লেষণ করলে প্রতিয়মান হবে, ঘটনাগুলি আত্মহত্যা না বলে কাঠামোগত হত্যাকান্ড বললেই অধিকতর শ্রেয়। আত্মহত্যা যিনি করেন এককথায় এটি বলা যায় তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। মানসিক অসুস্থতার কারণেই এটি ঘটে থাকে।

এখন আলোচ্য বিষয়, এই যে মানসিক অসুস্থতা এর জন্য প্রধানত দায় কার? অর্থাৎ একজন মানুষ কী কী কারণে মানুসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে? এর দায় প্রধানত সমাজ-রাষ্ট্রের। সমাজের মধ্যে যখন ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয় তখন সেই সমাজে বসবাসকারী নাগরিকের মধ্যে সেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। অসুস্থতার শুরু এখান থেকেই।

বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে লুটেরা ধনীক শ্রেণীর শাসকগোষ্ঠী কখোনো সামরিক কখোনো বেসামরিক স্বৈরতান্ত্রিক-ফ্যসিবাদী শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে গত ৫০ বছর ধরে। ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে সীমাহীন বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আত্মকেন্দ্রীকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়,অসহিষ্ণুতা, নিরাপত্তাহীনতা, অমানবিকতা, শারীরিক-মানসিক নিপিড়ন, বাকস্বাধীনতা না থাকা, ভয়ের সংস্কৃতি সবকিছু মিলিয়ে এ ভয়াবহ অস্থিরতা।

এই অস্থিরতায় স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শহরের বা গ্রামের যুবক-মধ্যবয়স্ক মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে মুক্তির উপায় হিসাবে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে আত্মহত্যা ব্যক্তিকেন্দ্রীক আচারণ মনে হলেও এটি মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনার মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল। আত্মহননকে এখন কাঠামোগত হত্যাকান্ড হিসাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। আমাদের এই লুটেরা রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থাই এই সকল ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

পরিসংখ্যান অনুযায়ি মানুষের মাথাপিছু আয় আর ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে আত্মহত্যার প্রবণতা শুধু বাড়ছেই না যা ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক বলে আখ্যায়িত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা যে ভেতর থেকে ধসে যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেটির উপসর্গগুলিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আলোকসজ্জা করে সমাজের ভেতরের এই অন্ধকারকে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।

সমাজ বিজ্ঞানী এমিল দ্যুর্কেম বলেছেন,‘Serious fault in social structure lead to and increase in the suicide rates’. অর্থাৎ সমাজ কাঠামোতে যখন ত্রুটি দেখা দেয় তখনই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের চাইতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক উপাদানকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসে গেছে।

আমাদের লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর এ বিষয়ে কোন নজর নেই। না থাকাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। উন্নয়নের নামে অবাধ লুটপাট আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে তারা আমাদেরকে এমন এক সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে যেখানে সেচের পানি না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করছে।
দুই কৃষকের এই মৃত্যু কী আদৌও আত্মহত্যা নাকি এই সমাজ ব্যবস্থা তাকে হত্যা করলো?? এই প্রশ্ন আমাদেরকে উত্থাপন করতে হবে। ‘আত্মহত্যা’ মানেই ‘পাপ’ আর ‘কাপুরুষতা’র পরিচয় মানদ্ধাতা আমলের এই সনাতনি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে বলে আমি মনে করি।

ইতিমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশ ‘আত্মহত্যা’ সম্পর্কিত সনাতনি চিন্তা থেকে বের হয়ে আসছে। বিভিন্ন শারীরিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ যেমন মৃত্যুবরণ করে, তেমনভাবেই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ‘আত্মহত্যাকারী’র মৃত্যু ঘটে। মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এই নষ্ট-পচাঁ-গলা সমাজের দায় অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। শারীরিক স্বাস্থ্য সুস্থ্য রাখার জন্য যেমন করণীয় আছে একইরকমভাবে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যেও আমাদের অনেককিছু করণীয় আছে।

মানসিক সুস্থতা রক্ষার জন্য ব্যক্তি প্রচেষ্টা রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়েও আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে সমাজের অভ্যন্তরের অস্থিরতা কমিয়ে আনা। সমাজ অসুস্থ থাকবে আর সেই সমাজের মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকবে এটা ভাবা হাস্যকর একটি বিষয়!

রোগাক্রান্ত হওয়ার উৎসমূল খুঁজে বের করতে হবে। রোগ সারানোর পাশাপাশি যদি কারণ অনুসন্ধান করা না যায় তবে সেই রোগের প্রার্দূভাব ঘটে। বাংলাদেশে আত্মহত্যা এখন সেই প্রার্দূভাব পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা সবাই ইঁদুর দৌঁড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতা সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের মধ্যে হতাশা, বিচ্ছিন্নতাবোধ আর বিষন্নতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখছে। যা আমাদের সৃজনশীলতা, স্বাভাবিক জীবনবোধকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সমাজের অভ্যন্তরে লড়াই করার শেষ শক্তিটুকু ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।

‘আত্মহত্যা’ নামক এই কাঠামোগত হত্যাকান্ড বন্ধ করার জন্য সর্বাগ্রে চাই একটা সুস্থ সমাজব্যবস্থা। সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যেটি বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এইমুহুতের্র আশু করণীয় সুস্থ সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করা যার যার অবস্থান থেকে।

শেয়ার করুন