ডেস্ক রিপোর্ট

৮ মার্চ ২০২২, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক নারী দিবসঃ নারী মুক্তি

আপডেট টাইম : মার্চ ৮, ২০২২ ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক::
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আলোচ্য বিষয় হয়ে থাকে নারী মুক্তি, স্বাধীনতা, অধিকার বা নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে। কিন্তু আলোকপাত করা হয় বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ না করে। নারীর মুক্তি বা ক্ষমতায়ন যেটাই বলি না কেনো সেটি একটি সামগ্রিক এবং অতি রাজনৈতিক আলোচনা সেটার উল্লেখ থাকে অনুজ্জ্বল! বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারী বাজারের আর অন্য দশটা পণ্যের সমতুল্য। অন্য পণ্যকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নারী কে বিজ্ঞাপনের প্রধান মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পূর্বে সমাজের আরো চারটি স্তর পার করার মধ্যে দিয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। নারীর ওপর নির্যাতন বা তার অধিকারের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয় দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। প্রথমতো, জীবনধারণ তথা উৎপাদনের ধরন এবং প্রজনন- এদেরমধ্যকার সম্পর্ক। দ্বিতীয়তো, একদিকে পরিবারের রুপ এবং অন্যদিকে সম্পত্তি মালিকানার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র- এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক। পরিবার বিবর্তনের আদি লগ্নে পশুর মতোই, মানুষের মধ্যেও শুরুতে প্রচলিত ছিলো অবাধ যৌন সম্পর্ক। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে পরিবারের প্রথম রুপ স্বগোত্র বিয়ের উদ্ভব হয়। শুধুমাত্র মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানদের যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়, ভাই-বোনদের মধ্যে তা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসাবেঅব্যাহত থাকে।

দ্বিতীয় ধাপে এসে ভাই-বোনের মধ্যে যৌন সম্পর্ক অবলুপ্ত হয়। প্রথমে নিজ ভাই-বোনের পরবর্তীতে পিতৃকুল ও মাতৃকুলের ভাই-বোনদের মধ্যে এই সম্পর্ক বন্ধ হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে গোষ্ঠী বিয়ে বিকাশ লাভ করে, যেখানে স্বামীদের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে স্ত্রীদের একটি গোষ্ঠীর বিয়ে হতো। এইসময়টিতেও সন্তানদের পিতৃ পরিচয় অজানাই থেকে যেতো। মাতৃ পরিচয় নিয়ে সংশয় থাকতোনা। ফলশ্রুতিতে বংশধারা কেবল মায়ের দিক থেকেই নির্ধারিত হতো, এটাকেই বলা হতো মাতৃতন্ত্র। এখানে নারীই ছিলো প্রধান, কারণ সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হতো মায়ের মাধ্যমে।

সমাজ বিকাশের তৃতীয় ধাপে এসে জোড় বাধা পরিবার বিকাশ লাভ করে। যেখানে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট হলো। তবে এই সমাজে পুরুষের বহুগামিতার অধিকার স্বীকৃত থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে যতোক্ষণ সে একজন পুরুষের কাছে থাকবে সেই পুরুষের কাছে তার আনুগত্য আবশ্যকীয় করা হয়। তবে যে কারুর পক্ষ থেকেই বিয়ের বন্ধনকে অনায়াসেই ছিন্ন করা যেতো। আর বিচ্ছেদের পর সন্তান পূর্বের ন্যায় মায়ের অধিকারেই থাকতো।

সময়ের ধারাবাহিকতায় পশুপালন, গবাদি পশুর প্রজনন, ধাতুর ব্যবহার, চাষাবাদের সূচনার মধ্য দিয়ে সম্পদের পরিমান বৃদ্ধি পেতে থাকে। পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবারে নারীর তুলনায় পুরুষের অবস্থান ক্রমশই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শক্তিশালী অবস্থানের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুরুষ উত্তরাধিকারের প্রচলিত প্রথা উচ্ছেদে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্ত যতদিন পর্যন্ত মাতৃঅধিকার দ্বারা বংশ পরিচয় নির্ধারিত হতো ততদিন পর্যন্ত সেটি ছিলো অসম্ভব প্রচেষ্টা।

একটি পর্যায়ে পুরুষ মাতৃ অধিকার উচ্ছেদ করে সেখানে পিতৃ অধিকার প্রতিষ্ঠা করলো। এর মাধ্যমে পুরুষের ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলো। নারীর ঐতিহাসিক পরাজয় ঘটলো। নারী পুরুষের যৌন চাহিদা পূরণ এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে রুপান্তরিত হলো।সমাজ বিকাশের চতুর্থ স্তরে পুরুষের ক্ষমতার ভিত্তিতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। এই সময়ে এসে জোড় বিয়ের স্থলে একনিষ্ঠ বিয়ে প্রথা চালু হয়। নারীর প্রতি পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে এই বিবাহ প্রথা শুরু হলো। একনিষ্ঠ বৈবাহিক বন্ধন অধিকতর মজবুত,এক পক্ষের মতামতের প্রেক্ষিতে বিয়ে ভাঙ্গা যেতোনা। শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার ছিলো বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার। এবং যৌথ জীবনে নারীকেই একনিষ্ঠ হতে হতো।

এই যে, বিবাহ প্রথা চালু হলো এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো পরিবারে পুরুষকে প্রধান করে তোলা ও তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার যাতে তার সন্তানের উপরেই বর্তায় সেটি নিশ্চিত করা। পরিবারের এই রুপটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে পুরুষ-নারীর মধ্যে কোন সম্প্রীতির ভিত্তিতে নয়, বরং এক লিঙ্গ কর্তৃক অপর লিঙ্গকে দমিত করার মাধ্যমে।

পৃথিবীতে এই সময়েই শ্রেণী- দ্বন্দ্ব এবং একগামিতা ভিত্তিক বিয়েতে পুরুষ-নারী দ্বন্দ্ব আবির্ভূত হয়। শ্রেণী নিপীড়ন পুরুষ কর্তৃক নারীর উপর নিপীড়নের মাধ্যমেই শুরু হয়। এঙ্গেলস বলেছেন,‘যেসব স্ত্রী স্বামীর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল তারা আসলে যৌন ও সামাজিক সেবা দানের বিনিময়ে জীবনধারণ করেন। যেমন বেশ্যাদেরও করতে হয়। সুতরাং বেশ্যা ও বেশ্যাবৃত্তি সম্পর্কে বুর্জোয়া নৈতিকতার আস্ফালন ভন্ডামি ছাড়া কিছু নয়’।

সামন্ততন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদ নারীকে আধুনিক শিল্প ও বিভিন্ন উৎপাদনশীল শ্রমে ফিরে আসার অনেকটা সুযোগ করে দেয়। সে অর্থে পুঁজিবাদের মধ্যে দেখা যায় প্রগতিশীল সম্ভাবনা, যা নারী মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক। কিন্তু সমাজের ‘অর্থনৈতিক একক’ হিসাবে পরিবারের চরিত্র তখনও থেকেই যায়। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই পুঁজিবাদ তার প্রগতিশীল সম্ভাবনাকে খারিজ করে। সেই অর্থে পুঁজিবাদ চুড়ান্তভাবে পশ্চাদমুখী ভূমিকা পালন করে।পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মজুরি নির্ধারিত হয় একজন শ্রমিক কী উৎপাদন করছে তার দ্বারা নয়, বরং তার ও তার পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মোট মূল্যের দ্বারা। এই ‘প্রয়োজনীয় সামগ্রীর’ অন্তর্ভূক্ত শুধুমাত্র খাদ্য বা বস্ত্র নয়, এর সাথে যুক্ত হয় খাদ্য প্রস্তুত করা, পোষাক তৈরি, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সেবা করা। এই সবকিছুই প্রয়োজনীয়তার অন্তর্ভূক্ত।

একজন নারী যখন স্ত্রী ও মা হিসাবে এসব প্রয়োজনগুলো মেটান তখন পুঁজিপতি কিন্তু এই পরিষেবা প্রদানের জন্য তাকে কোন পারিশ্রমিক দেয়না। সেকারণে ঘরের মধ্যে নারীদের কাজকর্ম হলো প্রয়োজনীয় শ্রমের অদৃশ্য অংশ, যার কোন হিসাব থাকেনা এবং বিনিময়ে পারিশ্রমিকও প্রদান করা হয়না। ফলশ্রুতিতে মজুরির সাধারণ হার কম রাখতে এটা সাহায্য করে। পুঁজিপতির জন্য শ্রমিকের পরিবার কম মূল্যে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের আধার। উন্নত পুঁজিবাদী দেশেও ধনী পরিবারগুলোতেও ঘরের শ্রমের প্রধান অংশ নারীকেই বহন করতে হয়। এটাকে ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘পারিবারিক’ বলে দেখা হয়, কিন্তু বস্তুত এটা পুঁজিবাদী শোষণের অপরিহার্য অংশ। এ জন্যই আমেরিকা হোক আর আমাদের দেশেই হোক ‘পরিবার’ এত মহান, পবিত্র ব্যাপার বলে চিহ্নিত করা হয়।

নারীদের জীবনে পুঁজিবাদের রয়েছে পরস্পরবিরোধী ভূমিকা। একদিকে নারীদের এমনকি শিশুদেরও সামাজিক উৎপাদনে টেনে আনে। অন্যদিকে, নারীদের মজুরিবিহীন গৃহশ্রমকে কাজে লাগিয়ে শ্রমের পুনরুৎপাদনকে আরো সস্তা করে তোলে এবং এভাবেই মজুরির সাধারণ স্তরকে নীচে নামিয়ে রাখে। গৃহশ্রম থেকে নারীদের সম্পূর্ন মুক্ত করার মতো উদ্বৃত্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত হয়। গার্হস্থ্য শ্রমের সামাজিকীকরণ বস্তুগত বা বৈষয়িক শর্তও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উপস্থিত থাকে। কিন্তু পুঁজিবাদ কখনও সেই উদ্বৃত্তকে বৃহত্তর সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেনা; তাকে সঞ্চিত রেখে দেয় পুঁজিপতির বিশাল মুনাফার স্বার্থে। মুনাফায় যার প্রধান কথা, সেখানে নীতি-নৈতিকতা কোন কিছুই মানদন্ড হিসাবে কার্যকর থাকে না।

সুতরাং এই আলোচনাতে বলা যেতেই পারে, নারী মুক্তি বা নারী স্বাধীনতা কোনভাবেই বিছিন্নভাবে সমাধান সম্ভব নয়। প্রচলিত এই লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চুড়ান্তভাবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাহলে কী আদৌও মুক্তি সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব এবং মুক্তির প্রশ্নটি জড়িত বিদ্যমান এই লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদের সংগ্রামের সাথে।

এঙ্গেলস বলেছেন,‘আমরা এমন এক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলেছি, যখন এতদিন পর্যন্ত যে এক বিবাহ প্রথা ও তার সঙ্গে সঙ্গে পতিতাবৃত্তিও চলেছে তার অর্থনৈতিক ভিত্তিটাই সরে যাবে। সমাজে এক বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে তখনই, যখন একজনের হাতে, নির্দিষ্টভাবে একজন পুরুষের হাতে, অনেক সম্পদ জমেছে, আর সে চেয়েছে তার সম্পত্তি যেন তার নিজের সন্তান ছাড়া আর কেউ না পায়। তাই নারীদের জন্য এক বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়েছে, পুরুষদের জন্য নয়। যাইহোক, আসন্ন সমাজ বিপ্লব স্থায়ী ও উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তিগুলোর সিংহভাগকে- উৎপাদনের উপকরণগুলিকে সামাজিক সম্পদে পরিণত করে এই সব উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দুশ্চিন্তার অনেকটাই অবসান ঘটাবে।

উৎপাদনের উপকরণগুলি যখন সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত হবে, তখন সর্বহারা শ্রেণী, মজুরি শ্রমও অবলুপ্ত হবে, নিশ্চিহ্ন হবে অর্থের জন্য কিছু মহিলার আত্মসমর্পন করার প্রয়োজনীয়তা। দেহ-ব্যবসার দিন শেষ হবে, এক বিবাহ প্রথা ভেঙ্গে পড়ার বদলে অবশেষে হয়ে উঠবে এক বাস্তবতা, যা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অণু পরিবারগুলো আর সমাজের অর্থনৈতিক একক হিসাবে থাকবেনা। ব্যক্তিগত গৃহস্থালীর কাজ সামাজিক শিল্পে পরিণত হবে।

শিশুদের যত্ন ও শিক্ষার বিষয়টি হবে রাষ্ট্রের দায়িত্বে; সমাজ সমস্ত শিশুদেরকেই সমান চোখে দেখবে, সে তারা বৈধ অবৈধ যাই হোক না কেনো। এর ফলে মেয়েরাও প্রিয়তমের কাছে নিজেদের উজাড় করে দিতে পারবে, কারণ নৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তার ‘ফলাফল’ সম্বন্ধে তখন আর এখনকার মতো দুশ্চিন্তা থাকবেনা। অথনৈতিক কারণেই নিজেদের ভরণপোষণের জন্যে, বিশেষকরে সন্তান-সন্তুতির ভবিষ্যৎ ভেবেই মহিলারা পুরুষদের দ্বিচারিতা বা বিশ্বাষঘাতকতা সহ্য করতে বাধ্য হয়। সেই অর্থনৈতিক বশ্যতার কারণগুলো যদি দুর হয়ে যায়, নারী যদি পুরুষের সমান অধিকার পায়, তবে নারীর সেই সমমর্যাদা তাদের বহুগামিনী করে তুলবেনা, বরং পুরুষরাই প্রকৃতপক্ষে একগামী হয়ে উঠবে’।

নারীর প্রধানমন্ত্রী, বৈমানিক হওয়া বা শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়ার মধ্যেই নারী মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন বা অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয় যদি কী না বর্তমান এই সমাজ ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না ঘটানো সম্ভব হয়। এই সমাজে লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন এর সাথে যেমন পুরুষ জড়িত খেয়াল করলে দেখবেন অনেক ক্ষেত্রে নারীরও অংশগ্রহণ থাকে! অর্থাৎ সমস্যাটি বিদ্যমান রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থাপনার। সুতরাং রাজনৈতিক সংগ্রাম ব্যতীত মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়।

শেয়ার করুন