ডেস্ক রিপোর্ট

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২:১৬ অপরাহ্ণ

রাজনীতির পুরনো চাল

আপডেট টাইম : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩ ২:১৬ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

রাজনীতি কী, কেন রাজনীতি, কারা করবে রাজনীতি, কাদের জন্য রাজনীতি এবং কীভাবে চলবে রাজনীতি এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলছে পরাধীন আমল থেকেই। ব্রিটিশ আমল গেল, পাকিস্তান আমল গেল কিন্তু রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক এখনো গেল না। বরং রাজনীতিতে নীতির কোনো অবস্থান থাকবে কি না, রাজনৈতিক নেতারা পরস্পরের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবেন কি না, ভাষার ব্যবহারে শালীনতা থাকবে কি না সেসব এখন আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ নেতাদের কথায় ইতিমধ্যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে কর্মীদের মধ্যে আর আতঙ্কিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

রাজনীতিবিদরা কাজ করেন বর্তমানে আর জনগণকে নিয়ে যাবেন ভবিষ্যতে এই প্রতিশ্র“তি দিয়ে থাকেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু কোন সে ভবিষ্যৎ? কেমন হবে তার রূপ, সেখানে কতটুকু থাকবে মানুষের অধিকার? উন্নয়ন হবে অনেক সেই স্বপ্ন যত জোর দিয়ে দেখাচ্ছেন কিন্তু সেখানে বৈষম্য কি বাড়বে নাকি সাম্য আসবে সে কথা তত পরিষ্কারভাবে বলছেন না।

বর্তমান সরকার গত ১৪ বছরে ক্ষমতায় থেকে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। তারা পদ্মা সেতু করেছে, মেট্রোরেল করেছে। এক্সপ্রেস হাইওয়ে করেছে। এতে মানুষের যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। ডলারের হিসাবে মানুষের গড় আয় ও বছরের হিসাবে গড় আয়ু বেড়েছে। ক্ষমতাসীনরা যত উচ্চকণ্ঠে এই সাফল্য প্রচার করে সাধারণ মানুষ ততটা উল্লসিত হতে পারে না। কারণ উন্নয়নের সুফল প্রধানত যাদের ঘরে (দেশে এবং বিদেশে) গেছে তারা আর যাই হন না কেন সাধারণ মানুষ নন। সাধারণ মানুষ দেখছে তাদের জীবনযাপন করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। দ্রব্যমূল্যের নাগাল ধরতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে জনপ্রিয়তা কিংবা জনগণের আস্থা ধরে রাখা যাবে বলে ভরসা পাচ্ছে না শাসক দল। অতীতে উন্নয়নের সাফল্য প্রচার করেও জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে অনেক শাসককে সেই ইতিহাস তো জানা আছে সবার। দেশকে গণতান্ত্রিক বলে মানলে মানুষকে কথা বলার স্বাধীনতা, চিন্তা করার স্বাধীনতা চায়, সমাবেশ করার স্বাধীনতা যেমন দিতে হবে তেমনি দিতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। এই ক্ষেত্রে উন্নয়ন তো দূরের কথা অধঃপতন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

মতপ্রকাশ ও প্রচারের জন্য রাজনীতিতে সভা-সমাবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনীতি থাকবে আর সভা-সমাবেশ হবে না এটা তো কল্পনাও করা যায় না। যে কারণে সামরিক সরকার বা অনির্বাচিত সরকার প্রথম রাজনৈতিক দলগুলোর যে অধিকার কেড়ে নেয় তা হলো সভা-সমাবেশ করার অধিকার। সেই কাজ যদি নির্বাচিত সরকারের দাবিদাররাও করেন অর্থাৎ সভা-সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেয় তাহলে নির্বাচিত আর অনির্বাচিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এই প্রশ্ন উঠবে জেনে সভা-সমাবেশকে নিষিদ্ধ করা নয়, কঠিন করে দেওয়ার চেষ্টা থাকে ক্ষমতাসীনদের। বর্তমানে সেই কাজ নিয়মিতভাবেই করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা বলে, পুলিশের অনুমতি নেওয়ার জটিল পদ্ধতি চালু করে তারা বিরোধী মতের সমাবেশ করা কষ্টকর করে তুলেছেন।

অথচ সরকারি দলের নানা সংগঠন, অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন প্রতিনিয়ত সমাবেশ করছে। সে সব সমাবেশে আগের সরকারের শাসনামলে কী কী অঘটন ঘটেছে, কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব কথা বলছেন। এই সব সমাবেশে তাদের প্রধান থেকে শুরু করে প্রায় সবাই বলছেন অতীত সরকারের দুর্নীতি, চুরি, অর্থ পাচারের কথা। যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের কাছে নানা তথ্য থাকে ফলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অসত্য বলছেন এ কথা বলা যাবে না। আবার বিরোধী দল তুলে ধরছে সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতির খতিয়ান। দুই পক্ষের রয়েছে বিপুলসংখ্যক সমর্থক। তারা এই দুই পক্ষের নেতাদের কথা সঠিক মনে করেন। ফলে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী মনে করে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের দল কেউ দুর্নীতির বাইরে নয়। ক্ষমতা এবং দুর্নীতিকে সমার্থক করে এক সময় বলেছিলেন জন এটকিন্স। তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চরম দুর্নীতিবাজের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে এই বিষয়ে সন্দেহ করার মানুষ তেমন নেই।

উন্নয়ন নিয়ে সরকারের প্রচারণায় অনেকে বলছেন, আকাশে চাঁদ উঠলে তা সবাই দেখে, কাউকে ডেকে দেখাতে হয় না। দেশের মানুষ যদি মনে করে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে তাদের জীবনমান বেড়েছে, সেবা পেতে কাউকে উৎকোচ দিতে হয় না, তাহলে তো আবার তাদেরই নির্বাচিত করবে। কিন্তু তারা যদি দেখে সরকারি দল করার সুবাদে কারও আঙুল ফুলে বটগাছ হয়েছে, বিরোধিতাকারীদের আঙুল (প্রতীকী অর্থে) ভেঙেছে আর গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ দিনযাপনের গ্লানি বয়ে চলছে, তখন তারা বিকল্পই খুঁজবে। বিরোধী দল বলছে ক্ষমতাসীন দল ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছে। তাই বিরোধী মত প্রচারে এত বাধা, হামলা-মামলা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে অনীহা।

মতপ্রকাশ এবং প্রচারের স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোট বা নির্বাচন। স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় সাফল্যের কথা সব শাসক বললেও গত ৫০ বছরে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার পদ্ধতি তৈরি করা যায়নি। ভবিষ্যতে যে সেটি পারবে, তার নিশ্চয়তাও নেই। কিছুদিন আগের গাইবান্ধা উপ-নির্বাচন এবং সর্বশেষ ৬টি আসনে যে উপনির্বাচন হলো, সরকারি দল মনোনীত ও পছন্দের প্রার্থীকে যেভাবে জিতিয়ে আনা হলো, তাতে পুরো ভোটব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর অর্থ অন্তত ৭৫ শতাংশ ভোটার এ উপ-নির্বাচনে আগ্রহ দেখাননি এবং অংশগ্রহণ করেননি। উপ-নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও পাকিস্তান আমলে টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচন একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ৪৯ সালের সেই উপ-নির্বাচনে খুররম খান পন্নি হেরে যান শামসুল হকের কাছে। এরপর মুসলিম লীগ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপ-নির্বাচন আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এবারের বগুড়া এবং কিছুদিন আগের গাইবান্ধা উপ-নির্বাচন সংশয় ও অনাস্থা বাড়িয়ে তুলেছে।

ধরে নেওয়া যেতে পারে, ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩-এর শেষ দিকে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করার সাংবিধানিক ও আইনি দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে। যদিও বাস্তবে সিদ্ধান্ত আসবে রাজনৈতিকভাবে। তারপরও বছরজুড়েই চলবে এই নির্বাচনের প্রস্তুতি। কিন্তু নির্বাচন শুধু দাপ্তরিক বিষয় নয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিগত নির্বাচনগুলো বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচন পর্যালোচনা করা। এই নির্বাচন দুটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য মাপকাঠিতে দুটি নির্বাচনই ব্যর্থ নির্বাচন বলে বিবেচিত হবে এবং এ নিয়ে সমালোচনা চলবে বহুদিন। ভবিষ্যতের নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে এই বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা চলবে না।

২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও বহু জায়গায় রাতে ব্যালট ভরে ফেলা এবং ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা যে ঘটেছে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সে কথা খোদ গত কমিশনের প্রধান নূরুল হুদাও প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন। এক প্রশ্নে তিনি ইভিএম ব্যবহারের যুক্তি হিসেবে রাতের ভোটের উদাহরণ টেনেছিলেন। এ বিষয়টি শুধু দেশে নয় এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার বিষয়। ফলে এর গুরুত্ব বর্তমান নির্বাচন কমিশনের উপলব্ধি ও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, আগামী নির্বাচন কেমন, কীভাবে ও কোন পরিবেশে হবে, তার প্রতিক্রিয়া রাজনীতিতে কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে ও আশঙ্কা বাড়ছে। সভা-সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনই মাঠ গরম হয়ে উঠছে।

পৃথিবীর দেশে দেশে নির্বাচন নিয়ে নানা পরীক্ষা ও সুরক্ষা আছে। উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারতে ক্ষমতাসীন সরকার রেখেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। আয়তনে ও জনসংখ্যায় বিশাল ভারত ফেডারেল রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দলের সরকার থাকে। ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশ শক্তিশালী রাখার প্রচেষ্টা আছে এবং আমলাতন্ত্র দক্ষ ও নিরপেক্ষ। ভারতে নির্বাচনকালে সরকারের প্রভাব ও ক্ষমতা সংকুচিত থাকে। ফলে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন ‘সুপার’ সরকার হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ এখনো আস্থা হারায়নি এবং ভূমিকা রাখছে। রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে মাত্র দেড় দশকের গণতান্ত্রিক দেশ নেপালে ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হয়েছে।

সে তুলনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের নানা ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রয়েছে। এ যাবৎকালের ১১টি জাতীয় নির্বাচন বিশেষ করে ২০১৪-১৮ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়নি যে দলীয় সরকারের অধীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এই আশ্বাস দিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিরা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাতে শুরু করেছেন। কিন্তু যেনতেনভাবে নির্বাচন হলে তা কি দেশের জন্য ভালো হবে, এই প্রশ্ন উঠছে জোরেশোরে।

পুঁজিবাদে বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে নেয় এবং আরও বড় পুঁজিপতি হয়। পুঁজিপতিরা যত বড় হয় ততই তার লুণ্ঠন করার ক্ষমতা বাড়ে এবং প্রতিযোগিতা করতে এলে ভয় দেখায় ছোটখাটো পুঁজির মালিকদের। ফলে অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়ে যায় ছোট পুঁজি। অবাধ প্রতিযোগিতার নামে অবাধে লুটপাট করার ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়। অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম হয় না। সম্পদ কুক্ষিগত করার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পদ্ধতি শক্তিশালী হয়। এই সব ক্ষমতাবান ব্যক্তি ক্ষমতাকে দমন করার, বিদ্রƒপ করার, তাচ্ছিল্য করার ক্ষমতা মনে করেন। ক্ষমতাবানদের কাছে হেরে যায় যুক্তি, নীতি হেরে যায় কৌশলের কাছে। ভবিষ্যতের নির্বাচন নিয়ে সেই পুরনো চালেই কি নতুন খেলা হবে?

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন