ডেস্ক রিপোর্ট

১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১:১২ পূর্বাহ্ণ

বিজয়ের দিনে পেছনে এবং সামনে দেখা

আপডেট টাইম : ডিসেম্বর ১৮, ২০২২ ১:১২ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

বিজয় দিবসে একাত্তরের কথা ভাবতে গেলে শিহরণ জাগে মনে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ ইশতেহার ঘোষণা, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্সের ঘোষণা, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১০ এপ্রিল প্রথম সরকার গঠন, ১৭ এপ্রিল প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ আর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়এক বছরেই এতগুলো অর্জন। স্বাধীনতা দিবস থেকে বিজয় দিবস ২৬৬ দিনের এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। রক্তেভেজা ভূখ-, একটি পতাকা, জাতীয় সংগীত আর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু বাংলাদেশের। আকাশচুম্বী আশা নিয়ে, সাগর পরিমাণ রক্ত দিয়ে, প্রতিজ্ঞা আর সাহসে ভর করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে রাইফেল, মুখে বিজয়ের উল্লাস নিয়ে আর সবুজের বুকে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়িয়ে যখন তারা দেশে মার্চ করছিল তখন সন্তানহারা মা তার হাহাকার ভুলে গিয়েছিল আর নির্যাতিত বোনটি মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিল। ভেবেছিল সবাই, এবার দেশটা আমাদের হবে!

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, সময়ের হিসাবে পার হয়ে গেছে ৫১ বছর, কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের কথা! এই ৫১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয় বরং অনেকেই বলছেন বিস্ময়কর। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির চিত্র দেখি তাহলে দেখব মাথাপিছু আয় ১১০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ২৮২৪ ডলার, জিডিপি ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে হয়েছে ৩৯৭ বিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া সেতু, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল আর মেট্রোরেল অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে দৃশ্যমান করেছে।

স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরিরা তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের ভবিষ্যতের জন্য। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে একটা জাতিকে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল তার নজির পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান, ২ লক্ষাধিক নারীর নির্যাতিত হওয়া, কোটি মানুষের গৃহহারা হয়ে দেশান্তরী হওয়া, গোটা দেশটাই একটা নির্যাতন ক্যাম্পে পরিণত হওয়ার ঘটনা যেমন বিশ্ববাসী জানে, তেমনি জানে কি অপরিসীম সাহস ও দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহ-মাসের ট্রেনিং নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজয়ের মুখোমুখি করেছিল বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা।

এই অসম লড়াইয়ে সাহসের উৎস কী ছিল? তা ছিল দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মুক্তি অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আকুতি। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে এই ভূখণ্ডের মানুষের বুকে পরাধীনতার গ্লানি আর চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম করেছে। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল কিন্তু তা পরিণত রূপ পায়নি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব ও ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের নামে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার যে বীজ বপন করা হয় এর ফলে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে গড়ে উঠে পাকিস্তান। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ হয়নি। যদি তা হতো তাহলে এশিয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল মিলে একটি মুসলিম দেশ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া মিলে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ হয়নি, তেমনি ভারত-নেপাল মিলে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেশ হয়নি। কারণ দেশ হতে গেলে ভূখণ্ডগত ঐক্য,সাংস্কৃতিক বন্ধন, ভাষা, অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতি দরকার হয়। যে কারণে এক ধর্মের মানুষ হলেও তাদের নিয়ে এক দেশ হয় না। তাই হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা সংস্কৃতির পার্থক্য নিয়ে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের যে দেশ গড়ে তোলা হয়েছিল, তা কোনো বিচারেই এক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি।

পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা, পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র তার বিপরীতে গণতন্ত্র, ব্রিটিশ শোষণ ও পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে শোষণমুক্তির আকাক্সক্ষা থেকে সমাজতন্ত্র আর দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ, এই আকাক্সক্ষাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের চেতনায়। তাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে গ্রাম শহরের শ্রমজীবী মানুষ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মধ্যবিত্ত নেমে এসেছিল আন্দোলন, অভ্যুত্থান আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে। সব পথ যেন মিশে গিয়েছিল মুক্তির আকাক্সক্ষায়, স্বাধীনতার মোহনায়।

কিন্তু ৫১ বছর পর আকাক্সক্ষা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গেলে দেখা যাবে অনতিক্রম্য এক বিশাল ফারাক যে তৈরি হয়েছে শুধু তা-ই নয় মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক সুউচ্চ দেয়াল। স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল যারা আর সুফল ভোগ করছে যারা তারা এক দেশের মানুষ হয়েও যেন এক জাতের মানুষ নয়। দুজন বাঙালি কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে আজ সোয়া লাখের বেশি কোটিপতি। যাদের মধ্যে আবার ২৫০ জন যেকোনো দেশের বিবেচনায় অতিধনীর পর্যায়ে পড়ে। শ্রমিকের এবং প্রবাসী শ্রমিকের শ্রমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে কিন্তু তাদের দুর্দশা কমে না। দেশের সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষ যাদের মজুরি বিশ্বে সবচেয়ে কম, ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রম বিক্রি করছেন বিদেশের বাজারে, দেশে বেকারত্ব এত তীব্র, যেকোনো একটা কাজ পাওয়ার জন্য যুবকরা মরিয়া হয়ে জীবনের ও আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে বিপদসংকুল ও অনিশ্চিত পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কৃষক ধান, সবজি, মাছ, ফল চাষ করে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছেই। শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের নিত্যনতুন খবর আসছে, প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছেন ধনীরা, সে টাকা জমছে বিদেশের ব্যাংকে। মানুষ দেখছে দেশের জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈষম্য, দুর্নীতি আর অসহায়ত্ব সবই বাড়ছে। এদিকে, ধর্মকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দুটোই বেড়েছে, ক্ষমতার স্বার্থে এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মাদনা বাড়ছে।

সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য এখন প্রধান ধারা, ফলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আকাশচুম্বী। সামাজিক ন্যায়বিচার এখন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানবিক মর্যাদা যে ভূলুণ্ঠিত তা নারীর লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর আক্রমণের চিত্র দেখলে বোঝা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং চর্চা এখন সবচেয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে। নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ না করে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধ ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। টাকা, পেশিশক্তি, প্রশাসন ও সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে নির্বাচনকে কলুষিত করার কাজ তো ধারাবাহিকভাবেই চলছিল কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন এক নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করে রেখেছে।

১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ আর আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার তারা মুক্তি পাবে শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে, আর মাথা নিচু করে থাকা নয়, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার মতো পরিবেশ পাবে। তা এখনো অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতার পর যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে তার ফলেই শোষণ ও বৈষম্য এত প্রকট রূপ নিয়েছে। এ কারণেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি কিন্তু শোষকদের প্রাপ্তি ঘটেছে ব্যাপক। শোষণ ও লুণ্ঠনকে অব্যাহত রাখতেই নিপীড়ন যেমন বাড়ছে, শোষণকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাও তেমনি প্রশ্রয় পাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের এই প্রবল জোয়ারেও গণতন্ত্র ও নৈতিকতার ভাটার টান মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। পেছন ফিরে তাকালে তাই স্বপ্ন আর প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে। ফলে স্বাধীনতা এলো কিন্তু সাধারণ মানুষ বিজয়ী হলো না এ কথা বলাই শুধু যথেষ্ট নয়, কেন হলো না তা যেমন জানা দরকার, তেমনি অপূর্ণ স্বপ্নপূরণের সংগ্রামটাও খুব জরুরি। এবং এই কথাটা মনে রাখা দরকার, যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এত বিপুল আত্মত্যাগেও মানুষের মুক্তি এলো না সেই ব্যবস্থা বহাল থাকলে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম আকাক্সক্ষা ছিল শোষণমুক্তি। তাই ১৯৭২ সালে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল তাতে কিছু দুর্বলতা থাকলেও এ কথা তো স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যতই শক্তিশালী হচ্ছে ততই ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে রাষ্ট্রধর্ম, সমাজতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি, জাতীয়তাবাদের বদলে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া জনগণ বিগত পাঁচ দশকে প্রত্যক্ষ করছেন। আর গণতন্ত্রচর্চার বেহাল দশা দেখছেন প্রতিদিন।

গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ নির্বাচন। ৫১ বছরেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার আইন ও প্রক্রিয়া চালু করা গেল না। তখন প্রশ্ন আসে, গণতন্ত্রহীন নির্বাচন, সাম্যের পরিবর্তে বৈষম্য, ন্যায়বিচারের পরিবর্তে বিচারহীনতা আর মানবিক মর্যাদার পরিবর্তে মানবিকতার অবনমনের এই বাংলাদেশ কি আমরা দেখতে চেয়েছিলাম? উত্তর যদি না হয়, তাহলে হারিয়ে যাওয়া বিজয়কে ফিরে পেতে লড়াই অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প তো নেই।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

[email protected]

শেয়ার করুন