ডেস্ক রিপোর্ট
১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১:৩০ পূর্বাহ্ণ
রাজেকুজ্জামান রতন:
আবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ২০২২ সালের জুনে বেড়েছে গ্যাসের দাম, আগস্টে বেড়েছিল জ্বালানি তেলের দাম, ২১ নভেম্বর বেড়েছিল পাইকারি বিদ্যুতের দাম আর ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে নববর্ষের উপহার হিসেবে বাড়ল খুচরাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এর প্রভাব পড়বে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। খরচ বাড়বে উৎপাদনের এবং সাধারণভাবে বাড়বে সব জিনিসের দাম।
বাজারে ডিমের হালি ৫০ পয়সা, চাল ২ টাকা সের, ১টা ইলিশ মাছ ৭/৮ টাকা, গরুর মাংস সের ২০/২৫ টাকা, এ কথা বললে চোখ কপালে উঠবে না কি! অবাক হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য দাম! বেশি দিন আগে নয়-ছয় দশক আগে এসব পণ্যের দাম এমনই ছিল, এখন এসব পণ্যের দাম কত? এখন ৪০ টাকায় এক হালি ডিম, ১ কেজি চাল ৫০ থেকে ৯০ টাকা, ১টা ইলিশ (মাঝারি) ১ হাজার টাকা আর ৬০০ টাকা কেজিতে কিনতে হয় গরুর মাংস। কিন্তু যে পরিমাণে পণ্যমূল্য বেড়েছে সে অনুপাতে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় বেড়েছে?
টাকা ক্রমাগত মূল্যহীন হচ্ছে পণ্যের কাছে। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে টাকার মূল্যমান যে ঢাকায় রিকশার সর্বনিম্ন ভাড়াও এখন আর ২০ টাকা নিতে রাজি হয় না রিকশাওয়ালারা। ভিক্ষুককে ১/২ টাকা দেওয়া যায় না। আর অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে পয়সা। ক্রমাগত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পয়সা হারিয়ে গেছে প্রায় মুদ্রাবাজার থেকে। অথচ স্বাধীনতার পরেও বহুদিন পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সা ইত্যাদি বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এগুলোর ব্যবহার ক্রমেই কমতে থাকে। মূলত নব্বই দশকের গোড়া থেকেই পয়সার ব্যবহার কমতে থাকে। আর তার পরিবর্তে এক টাকা সমমানের মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। বর্তমানে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার সমমানের মুদ্রা বাজারে চালু রয়েছে।
টাকার দাম কমছেই না শুধু এশিয়াতে অনেকের চেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স বাংলাদেশের টাকার। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ও ক্রেডিট ডেফিসিটের জন্যই টাকার দামের এই রেকর্ড পতন। টাকার মূল্য আসলে কী? একই সাইজের কাগজের টুকরার কোনো মূল্য নেই কিন্তু টাকার আছে। সেক্রেটারি অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেকোনো মূল্যমানের টাকায় স্বাক্ষর করে সত্যায়িত করলেই টাকার মূল্য হয়ে যায়। ফলে টাকা হলো এক প্রকার অঙ্গীকারনামা। গভর্নর সাহেব টাকার গায়ে যে অঙ্ক লিখে দেবেন এবং বাহককে দেওয়ার অঙ্গীকার করবেন সেটাই টাকার মূল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। নইলে এক টুকরা কাগজের আর কিইবা মূল্য। টাকার এ মূল্য যে দিন দিন নিচে নামছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দেশের মানুষ।
দ্রব্যমূল্য লাগামহীন এবং দুবছর ধরে বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণহীন। অজুহাত হিসেবে কভিড আর রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বলা হয়, তবে এর ফলে যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে সিন্ডিকেট। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের যেমন নাভিশ্বাস উঠেছে, গরিব মানুষের কষ্ট বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। কারণ, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন আর গরিব মানুষকে খাবারের পেছনে তাদের আয়ের বেশির ভাগই ব্যয় করতে হয়, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই বেশি ক্ষতি এবং এতে তাদের কষ্ট অনেক বেড়ে যায়। টাকার দাম প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে আর বিপরীতে পণ্যের দাম বছর বছর বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। এক বছরের পণ্যের দামের সঙ্গে পরের বছরের দাম মিলছে না। বাড়ছে সীমাহীন গতিতে।
টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হলো, টাকার তুলনায় আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে বছর ঘুরলেই বেশি টাকা লাগছে। তাই আমদানিপণ্যের মূল্য বাড়ছে। এক বছরের চিত্রটা দেখলেই বোঝা যাবে বছর বছর কীভাবে দাম বাড়ছে। এপ্রিল মাসে দেশে খুচরো পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তুলনার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ৪.২৩ শতাংশ। জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ছিল ৮.৩৮ শতাংশ। অবাক ব্যাপার হলো, পাহাড়ি এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি।
আবার সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশিগ্রামে ৮.৫ শতাংশ আর শহরে ৮.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরো বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটাকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। বছর বছর পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি একবার কোনো কিছুর দাম বাড়লে আর তা কমে না। চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম বেড়েই চলেছে আর টাকার মূল্য যাচ্ছে কমে।
আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব অবহেলা এবং দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা করে থাকে ক্ষমতাসীনরা। বিশ্ববাজারের প্রভাবটি অমূলক নয়। তবে দায় স্বীকারের উদাহরণ দেওয়া হয় না। যেমন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রিটেনে তিন মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর পেয়েছে তারা। প্রথমে বরিস জনসন পদত্যাগ করলেন; ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর লিজ ট্রাস আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করলেন। এরপর এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ঋষি সুনাক। কিন্তু আমাদের দেশে দায়গ্রহণ ও পদত্যাগের এ রকম কোনো নজির নেই। মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা তাদের সাফল্যের বর্ণনা দেন, আর জনগণ অমøান বদনে শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
তাই তো দীর্ঘ ৫০ বছরেও নানা সূচকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও বণ্টনজনিত বৈষম্যের কারণে দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি ছাড়া জনগণ খুব বেশি কিছু পায়নি। উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে এবং করছে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি। মাত্র দুজন কোটিপতি দিয়ে যাত্রা শুরু করা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজির কেন্দ্রিকতা আর আয়-বৈষম্য। এর ফলে ২০২২ সালেও মূল্যস্ফীতির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে অতিবাহিত করেছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাজার তদারকির ব্যর্থতা। ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দাম বাড়িয়েছে। অন্য কারণটি হলো টাকার অবমূল্যায়ন। তাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আক্রমণ করেছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমতে শুরু করেছে, জ্বালানি তেলের দামও নিম্নমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক দিকটিও গেল বছরের মতো প্রতিফলিত হবে না। তবুও দাম কমবে বলে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কৃষির সাফল্য নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কৃষির ভালো অবস্থা কিংবা ভালো ফলন মানেই কৃষি মজুরের ভালো অবস্থা নয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদনে কৃষি মজুরদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। তারা ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপক হিসেবে চাল ক্রয়ের সক্ষমতাকে বিবেচনা করেছেন। তাদের ২০১৯ সালের পর থেকে গত চার বছরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা ৩৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষি মজুরের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর থেকে ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে বর্তমানে ২০১৫ সালেরও নিচে নেমে গেছে। ২০১৫ সালে একজন শ্রমিক তার দৈনিক শ্রমলব্ধ মজুরি দিয়ে ১০ দশমিক ১ কেজি চাল কিনতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দৈনিক মজুরি দিয়ে তা ১০ দশমিক ৬ কেজিতে উন্নীত হয়। এভাবেই ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪ কেজিতে দাঁড়ায়। এর পরের বছর থেকেই কমতে থাকে কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা। ২০২০ সালে একজন কৃষিশ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে চাল কিনতে পারতেন ৯ দশমিক ১ কেজি; ২০২১ সালে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ৬ কেজিতে আর ২০২২ সালে তা ৮ দশমিক ৫ কেজিতে নেমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে খানাপ্রতি বার্ষিক ব্যয়ের প্রায় ৩৪ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এ খাদ্যব্যয়ের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় চাল কেনা বাবদ। গত তিন বছরে দেশে চালের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, যা গোটা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই চালের মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ নিয়েই ২০২২ সাল শেষ হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমে গেছে। গত এক দশকে এটাই ছিল অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় চাপ। সেই আশঙ্কা এখনো কাটাতে পারছি না আমরা। যদিও অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের হিসাব মতে, কমপক্ষে তিন মাসের আমদানিব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকতে হয়। এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু তা হওয়া কঠিন। রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব উল্লিখিত অঙ্কের চেয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কম হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। রিজার্ভের পরিমাণ তো এক বছর আগেও ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলার। এর অর্থ হলো, ১ হাজার ১৭৯ কোটি বা ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে জনজীবনে প্রকটভাবে। এর সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
লেখক: বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সম্পাদক ও কলামিস্ট