ডেস্ক রিপোর্ট

২৮ অক্টোবর ২০২২, ২:২৫ অপরাহ্ণ

কাশ্মির ইস্যুতে ভারতকে চাপ দেবেন সুনাক, আশা পাকিস্তানিদের

আপডেট টাইম : অক্টোবর ২৮, ২০২২ ২:২৫ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন ঋষি সুনাক। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর চলতি সপ্তাহে সুনাককে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস।

ব্রিটেনের গত ২০০ বছরের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ এবং প্রথম অশেতাঙ্গ এই প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন পাকিস্তানিরা। তাদের আশা, ঋষি সুনাকের ‘শিকড়’ পাকিস্তানে হওয়ায় কাশ্মিরর সংকট সমাধানে ভারতকে চাপ দেবেন তিনি। গত বুধবার (২৬ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তার ভারতীয় এবং হিন্দু ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। তবে তার শিকড় রয়েছে বর্তমান পাকিস্তানে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পাকিস্তানের পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা শহরে বসবাস করতেন সুনাকের পিতামহ অর্থাৎ দাদা।

সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারত ও পাকিস্তানকে আলাদা তথা দেশভাগের সময় গুজরানওয়ালা শহরে ১৯৪৭ সালে বেশ কিছু মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। তবে দেশভাগের সেই অস্থির সময়ের আগেই চাকরির জন্য পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা শহর ছেড়ে কেনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন সুনাকের দাদা রামদাস সুনাক।

ভারতের সীমান্তবর্তী পাঞ্জাব প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শিল্প কেন্দ্র গুজরানওয়ালার অনেকেই আজ বলছেন, যুক্তরাজ্যের নতুন নেতা কাশ্মির সংকটের সমাধানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করছেন। কারণ কাশ্মিরই দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বিবাদের মূল বিষয়।

এপি বলছে, সুনাকের দাদা রামদাস সুনাক এবং দাদী সুহাগ রানী ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত গুজরানওয়ালায় বসবাস করতেন। যদিও শহরের এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দার সেই অনেক আগের দিনগুলোর কোনো স্মৃতি নেই।

তারপরও তারা বলছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদে ৪২ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের বিজয়ে তারা আনন্দিত বোধ করছেন। তারা আশা করছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের অধীনে পাকিস্তান ও ব্রিটেনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও উন্নত হবে।

গুজরানওয়ালার কুস্তি খেলার বেশ সুনাম রয়েছে। মূলত এই খেলাটিই গুজরানওয়ালাকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করেছে। আর এই শহরেরই ওমর আলী নামে একজন কুস্তিগীর ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বেশ খুশি। তিনি বলছেন, এটি আনন্দের বিষয় যে- যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই এখানে বসবাস করতেন।

স্থানীয় এক কলেজের অধ্যাপক খুররম শেহজাদের আশা, ঋষি সুনাক শুধু পাকিস্তান ও ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতেই কাজ করবেন না বরং পাকিস্তান ও ভারতের জন্য ‘সাফল্যের নতুন যুগ’ নিয়ে আসবেন।

গুজরানওয়ালা শহর কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ফলে সেই সময়কার বেশিরভাগ রেকর্ড ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সুনাকের দাদা শহরের ঠিক কোথায় থাকতেন তার কোনো প্রমাণ এখন আর নেই।

তবে গুজরানওয়ালার বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, শহরের মাছলি বাজার এলাকায় হয়তো সুনাকের দাদা-দাদী বসবাস করতেন। কারণ সেসময় শহরের বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায় এখানেই বাস করত।

এপি বলছে, দেশভাগের আগে-পরে বহু হিন্দু এখান থেকে ভারতে চলে গিয়েছিল। তবে এখানকারই একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দির এখনও এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসের প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।

মাছলি বাজার, নামটি অনুবাদ করলে হয় ‘মাছের বাজার’ এবং আশপাশের এলাকাটি তার সুস্বাদু খাবারের জন্য পরিচিত। প্রতি বছর খাদ্যপ্রেমীদের ভিড় এখানে লেগেই থাকে — তবে তা শুধু ভাজা মাছ নয়, অন্যান্য উপাদেয় খাবারের জন্যও মানুষ এখানে আসেন।

হাফিজ উমর নামে এক ব্যক্তির পরিবারের মাছলি বাজারে বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তিনি বলছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পদে সুনাকের নিয়োগ আমাদের জন্য এবং আমাদের শহরের জন্য একটি সম্মানের বিষয়। আমরা আশাবাদী আগামী দিনে পাকিস্তান ও ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হবে।

পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র মুসাররাত জামশেদ চিমা বলছেন, ‘মনে হচ্ছে ঋষি সুনাকের অগ্রাধিকার হবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। তবে আমরা আশা করি তিনি কাশ্মির সমস্যাও সমাধান করার চেষ্টা করবেন। এটিই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিবাদের প্রধান কারণ।’

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪২ বছর বয়সী ঋষি সুনাক ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে হিন্দু-পাঞ্জাবি বাবা-মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার দাদা-দাদি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই তারা বেড়ে ওঠেন।

ঋষির দাদা রামদাস সুনাক ১৯৩৫ সালে নাইরোবিতে কেরানি হিসাবে কাজ করার জন্য গুজরানওয়ালা ছেড়ে চলে যান। এসময় তার স্ত্রী সুহাগ রানী সুনাক তার শাশুড়ির সাথে দিল্লিতে যান এবং সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে কেনিয়ায় নিজের স্বামীর কাছে চলে যান। রামদাস ও সুহাগ রানীর ছয় সন্তান ছিল। যাদের মধ্যে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে।

আর ঋষি সুনাকের বাবা যশবীর সুনাক ১৯৪৯ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে আসেন এবং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনে অধ্যয়ন শুরু করেন।

যশবীর ১৯৭৭ সালে লিসেস্টারে উষাকে বিয়ে করেন। এর তিন বছর পর ১৯৮০ সালে ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে ঋষির জন্ম হয়। ঋষির বাবা-মা অবসর গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত ফার্মেসি ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।

অবশ্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে সুনাকের মনোনয়নের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তাকে শুভেচ্ছা জানান। চলতি সপ্তাহে টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় শেহবাজ শরিফ বলেন, ‘কনজারভেটিভ পার্টির নেতা এবং যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হওয়ায় ঋষি সুনাককে অভিনন্দন। আমি উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে এবং স্থায়ী – অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করতে তার সাথে কাজ করতে উন্মুখ।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বেশ দ্রুত ঋষি সুনাককে অভিনন্দন জানান। অভিনন্দন বার্তায় মোদি বলেন, ‘আপনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আমি বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে আপনার সঙ্গে একত্রে কাজ করতে এবং রোডম্যাপ ২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আমরা আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আধুনিক অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত করতে চাই।’

উল্লেখ্য, কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। এখন উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে তবে ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাবার আগে থেকেই কাশ্মির নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল।

১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে কাশ্মিরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

উভয় দেশের এই যুদ্ধ চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে। এরপর কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় ১৯৪৮ সালে, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মির কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।

অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চীন কাশ্মিরের আকসাই-চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। আর তার পরের বছর পাকিস্তান – কাশ্মিরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়।

সেই থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন – এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।

শেয়ার করুন