ডেস্ক রিপোর্ট

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ৮:৪৮ অপরাহ্ণ

করোনা বিস্তারের প্রাথমিক কারণ ছিল সাধারণ ছুটির আগে মানুষের ঢাকা ত্যাগ

আপডেট টাইম : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১ ৮:৪৮ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

অধিকারবিডি ডেস্ক:: ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ওই ছুটি শুরুর আগে ২৩ থেকে ২৬ মার্চ মানুষের ঢাকা ত্যাগ মূলত দেশব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রাথমিক কারণ।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আইসিডিডিআর,বি এবং আইদেশিসহ দেশি-বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এক গবেষণাপত্রে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জিনোমিক কনসোর্টিয়ামের আওতায় বিশ্লেষণধর্মী ওই গবেষণাপত্রে করোনার দেশব্যাপী বিস্তার এবং তা প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় লকডাউন এবং জনসাধারণের গতিবিধির ভূমিকা কেমন ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। বিস্তার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার মার্চ মাসের ২৩ তারিখে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।

বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম থেকে সংগৃহীত ফেসবুক এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী ২৩ মার্চ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে জনসাধারণের ঢাকা ত্যাগ করার প্রাপ্ত ডাটার সাথে সার্স-কোভ-২ জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মার্চ ২৩ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে ঢাকা বহির্মুখী যাতায়াতই মূলত দেশব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রাথমিক কারণ।

চলতি মাসের ৪ তারিখে ‘জিনোমিক্স, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড মোবাইল ফোন ডেটা এনাবল ম্যাপিং অব সার্স-কভ-২ লিনিয়েজেস টু ইনফর্ম হেলথ পলিসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাপত্রটি নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত, দেশব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারে লকডাউনের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে জনসাধারণের চলাচলের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, আইদেশি, বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক স্যাঙ্গার জিনোমিক ইনস্টিটিউট, হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং ইউনিভার্সিটি অব বাথ-এর বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই গবেষণাটি শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে মার্চ-জুলাই ২০২০ অন্তর্বর্তীকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ৩৯১টি করোনাভাইরাস এর জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়।

বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস প্র্রবেশের সম্ভব্য সময় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। পরবর্তীতে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার ঘটে।

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, এপ্রিল ২০২১-এ কনসোর্টিয়াম নভেম্বর ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ এর মধ্যে সংগৃহীত আরও ৮৫টি সার্স-কোভ-২ নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩০টি ছিল লিনিয়েজ বি.১.১.২৫ (৩৫%), ১৩টি ছিল আলফা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭, ১৫%), ৪০ টি ছিল বিটা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১,৪৭%), ১ টি ছিল লিনিয়েজ বি.১.১.৩১৫, এবং ১ টি ছিল লিনিয়েজ বি.১.৫২৫। প্রথম ঢেউয়ে করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে- যেমন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, আমাদের এই কনসোর্টিয়াম বিভিন্ন সময়ে নীতিনির্ধারকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে সহায়তা করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ করা, পরিবহন চলাচলে সীমাবদ্ধতা আনা, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন এবং যেসব দেশে উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্ট ছিল সেখান থেকে আগত ভ্রমণকারীদের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা রাখা, সময়মতো লকডাউনের সিদ্ধান্ত বা প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক চলাচল সীমাবদ্ধ করা। আমাদের এই কনসোর্টিয়াম গত বছরের মার্চ মাস থেকে একত্রে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এই কাজ চলমান থাকবে এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজনীয় প্রমাণভিত্তিক তথ্য সরবরাহ করতে পারব।’

এই গবেষণাপত্রটির মূল-লেখকদের একজন ডক্টর লরেন কাউলি বলেন, ‘কীভাবে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, জেনোমিক এবং মবিলিটি, ঢাকা থেকে বিভিন্ন ডাটা স্ট্রিম একত্রিত করে আমরা তা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছি। এই গবেষণাটিতে মহামারি প্রতিরোধে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে যা ভবিষ্যতে অন্যান্য মহামারির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নিকোলাস থমসন বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ওপর একসাথে কাজ করছি। বিজ্ঞানীরা যখন জনস্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সাথে যৌথভাবে একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করেন তখন কতটা সাফল্য অর্জন করা যায় এই গবেষণাপত্রটি তারই একটি বাস্তব উদাহরণ।’

হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অধ্যাপক ক্যারোলিন বাকি বলেন, ‘মবিলিটি ডাটা, প্রথাগত চলমান সার্ভেলেন্স সিস্টেমের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এ ধরনের একটি মিলিত বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারে, যা অন্য কোনো উপায়ে অর্জন করা কঠিন। এই ধরনের গবেষণা শুধুমাত্র চলমান করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।’

আইসিডিডিআর,বি-র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদানকারীদের একজন ডক্টর ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা এবং লকডাউনের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও আমার সহকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক কোলাবোরেটরদের সহযোগিতায় আমরা সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আমাদের দায়িত্ব এই গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরো পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন দেশে কয়েক মাস পরপর মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ভেরিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে এবং এর মধ্যে কিছু ভেরিয়েন্ট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে দেশের সব মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার। এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা বোঝার জন্য আমাদের এ ধরনের কাজ অব্যাহত রেখে সরকারকে সময় মতো সঠিক তথ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে হবে।’

এই গবেষণায় ফেসবুক ডেটা ফর গুড, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি আজিয়াটা লিমিটেড জনসংখ্যা মোবিলিটি তথ্য সরবরাহ করেছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সার্স-কোভ-২ নমুনার সিকোয়েন্সিং-এ সহায়তা করেছে।

অধিকারবিডি/প্র.পা.

শেয়ার করুন