ডেস্ক রিপোর্ট

১২ নভেম্বর ২০২২, ৬:১৪ অপরাহ্ণ

অর্থনৈতিক চাপ এবং দুশ্চিন্তার বোঝা

আপডেট টাইম : নভেম্বর ১২, ২০২২ ৬:১৪ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন ::

একটা সময় ছিল যখন পত্রিকায় খবর ছাপা না হলে তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো না আর পত্রিকা পড়লে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। গল্পের মতো জনশ্রুতি ছিল যে, জমিদার বাবুর বাড়ির সামনের গাছ ঝড়ে পড়ে গেছে বলে পেয়াদা যখন এসে জানাল তখন বাবু বলেছেন, কোথায় পেলি খবর, কোন পত্রিকায় উঠেছে? অর্থাৎ পেয়াদার চোখের চেয়ে পত্রিকার ছাপা অক্ষর ছিল অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এখন সেই জমিদারির দিন আর নেই। কিন্তু সেই প্রবণতা কি একেবারেই নেই? আছে এবং প্রবলভাবেই আছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের রাজা না হলেও জমিদার তো মনে করেনই। ফলে নিজের দেশের জনগণ, সুধীসমাজ, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যত গুরুত্বপূর্ণ কথা, যুক্তি এবং উদাহরণ উপস্থাপন করুন না কেন, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে না বলা হলে সে কথার গুরুত্ব নেই। সে কারণে আইএমএফের প্রতিনিধিদল যখন দেশের অর্থনীতি নিয়ে বলছে তখন কিছুটা নড়ে-চড়ে উঠছেন কর্তাব্যক্তিরা।

দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে এবং তা সহসা কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘ হচ্ছে। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচক আগের তুলনায় আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট আরও বেড়েছে এবং আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা আছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা বিশ্বজুড়েই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করছেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতি মাসে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে। চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের গতি কমেছে। আর বৈদেশিক মুদ্রা খরচের প্রধান খাত আমদানি ব্যয় বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা কম বলে লেনদেনের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।

এসব আলোচনা সাধারণ মানুষ না করলেও এসব বিষয় তাদের জীবনে প্রভাব ফেলছে ভীষণভাবে। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। এর ফলে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু আয় তো বাড়ছেই না বরং প্রকৃত আয় কমেছে। অন্যদিকে যাদের জন্য রাষ্ট্র সহায়তা দেয় সবচেয়ে বেশি সেই উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা বিদ্যুৎ, জ্বালানি-সংকট ও ডলার। জ্বালানির দাম বেশি, বিদ্যুতে লোডশেডিং, ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে আর বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ডলার সংকট নিয়ে।

এর প্রভাব পড়েছে মন্ত্রীদের কথায়ও। দুমাস আগেও যারা বলেছিলেন দ্রব্যমূল্য বাড়লেও সমস্যা নেই কারণ মানুষের আয় বেড়েছে। মানুষ এখন আনন্দ নিয়েই বাজার করতে যান। তারাও চুপসে গেছেন। কারণ বাস্তবতাকে আড়াল করতে পারছেন না। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অবশেষে বলেছেন, ‘অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ আছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত সূচকগুলো যে পর্যায়ে আছে, তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়মিত করতে পারলে উৎপাদনব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তাহলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সমর্থন পেলে ডলারের সংকটও কেটে যাবে। খাদ্যসংকটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আমনের ফলন ভালো হয়েছে। বোরোর ফলনও ভালো করার প্রস্তুতি চলছে। কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক আছি।’ অনেকগুলো যদির ওপর নির্ভর করে দেওয়া তার বক্তব্যের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতির মিল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ দেশের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে এর হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যদিও সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। বাংলাদেশ আমদানি করে বেশি, তাই অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব পরিস্থিতিদুদিক থেকেই বাংলাদেশের ঝুঁকি আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এখানে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হলো ২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এর মানে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভবিষ্যতেও স্বস্তির খবর নেই। আর খাদ্য উৎপাদন আর আমদানির তথ্যের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। একদিকে বলা হয় খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্যদিকে উৎপাদন মৌসুমেও খাদ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে প্রতি বছরই।

গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর কিছুটা ছেড়ে দেয়। এরপর ডলারের দর আর তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাজারে ডলারের দর ১১২ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা শুরু করে। এতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলারে, যা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে, যা কয়েক মাস আগেও ছিল সাত মাস। যদিও আইএমএফ প্রতিনিধিদলের মতে, হিসাবটি পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, নানা কারণে ৭২০ কোটি ডলার ব্যবহার করা হয়েছে, সেই হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৭০০ ডলারের কিছু বেশি। আবার সরকারের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ও এখন অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী আয় করতে পারছে না, কিন্তু খরচ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে জ্বালানির দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখন চেষ্টা রয়েছে সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর মূল উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। দুই ক্ষেত্রেই আয় টানা দুই মাস কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা যায়, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে কমেছিল সোয়া ৬ শতাংশ। অথচ এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা, সামনে এই আয় আরও কমবে। আবার গত অক্টোবরে আসা প্রবাসী আয় গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে গত চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি সামান্য, মাত্র ২ শতাংশ। আশার কথা এই যে, চলতি অর্থবছরে ৯ লাখের বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। তারা আয় পাঠানো শুরু করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে এজন্য বাজারদর মেনে বিনিময় হার ঠিক করাটা জরুরি। নইলে হুন্ডি আরও বাড়বে। অর্থপাচার ঠেকানোর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ সরকারের নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার ডলারের উচ্চদর সামলাতে বিনিময় হার নিয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বদলে ফেলা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে না।

ডলারের চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। রপ্তানি আয় যাদের নেই, তাদের ঋণপত্র খুলতে চাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে অনেক ব্যবসায়ীই ঋণপত্র খুলতে পারছেন না বলে পণ্যসংকট দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির সামনের বড় হুমকি হচ্ছে, একই সঙ্গে মন্দা ও মূল্যস্ফীতির উপস্থিতি এবং সরকারি ও বেসরকারি ঋণ পরিশোধের দায়ের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।

অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আগামী বছরেও যাবে না বলেই সবাই পূর্বাভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। কারণ আমরা জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমদানির জন্য ডলার পাবে কোথায়? এ রকম এক অবস্থায় ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিদল এসেছিল। তারা ফিরে গিয়ে কী রিপোর্ট দেবে তার ওপরই নির্ভর করছে ঋণের ভবিষ্যৎ। আইএমএফ ঋণ দিলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এগিয়ে আসবে এই ভরসা করছে সরকার।

বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব পরিস্থিতিদুদিক থেকেই ঝুঁকি আছে বলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এরই মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। কিছুদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশে এবং বিদেশে চাহিদা থাকলেও সে অনুযায়ী কল-কারখানা উৎপাদন করতে পারছে না। ডলার সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলসহ জ্বালানি তেল এবং এলএনজি আমদানিতে রাশ টানা হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার শিল্পেও উৎপাদন কমে যাচ্ছে। খাদ্য সংকটের কথা বলে দুর্ভিক্ষের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সতর্কবার্তাই তো যথেষ্ট নয় খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষিতে যথাযথ পদক্ষেপটা জরুরি।

আইএমএফের ঋণ প্রস্তাব ৪৫০ কোটি ডলারের। পাওয়া যাবে ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে। প্রতি কিস্তিতে ৬৪ কোটি ডলার অর্থাৎ মাসে ১১ কোটি ডলারের কম। অন্যদিকে গড়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশের আমদানি খরচ ৭৫০ কোটি ডলার। অনুপাতটা কিন্তু খুব কম। তার পরও আইএমএফের শর্তে সরকার যদি আমদানি শুল্ক কমায় তাহলে দেশীয় শিল্প হুমকির মধ্যে পড়বে, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম যদি বাড়ায় তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, বেশি সুদের হারে (২.২০ শতাংশ) ঋণ নিলে পরিশোধের দায় বাড়বে। দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি, ডলার পাচার বন্ধ না করে, ঋণখেলাপিদের টাকা উদ্ধার না করে এবং কৃষিতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে যদি অনৈতিক ও অসম শর্তে ঋণ নেওয়া হয় তাহলে জনগণের কাঁধে ব্যয়ের বোঝা আর কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ বাড়তেই থাকবে।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন