ডেস্ক রিপোর্ট

১৭ মে ২০২৩, ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ

শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিনামার পক্ষে যৌক্তিকতা

আপডেট টাইম : মে ১৭, ২০২৩ ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি অপরিহার্য কেনÑএ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের ভাবতে হবে শ্রমিকেরা মজুরি চান কেন? শ্রমিকদের শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা হয়। মালিকপক্ষ উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে মুনাফা করেন। মালিক শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে পান মুনাফা। শ্রমিক তার জীবিকা নির্বাহের জন্য চান মজুরি। ফলে মজুরি ও মুনাফা দুটি পরস্পরবিরোধী জায়গা দাঁড়িয়ে থাকে। মালিক যতো বেশি মুনাফা নেন, শ্রমিকদের মজুরি ততোই কম হয়!

শ্রমিকদের মজুরি দরকার তাদের টিকে থাকার জন্য। একজন শ্রমিক তার পরিবারের অন্ন, বাসস্থান, পোশাক, চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া, বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনা করতে হয়। এমনকি মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবনা থাকে। শুধু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যই শ্রমিকদের মজুরি দরকার তা নয়, শ্রমিক তার মজুরি দিয়ে বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনেন। ফলে শ্রমিক নিজে উৎপাদন করেন তা নয়, অন্যরা যা উৎপাদন করে সেটি ভোগ করেও উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখেন তারা। ফলে সামগ্রিকভাবে একটা দেশে বা বিশে^ অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য শ্রমিকেরা একদিকে যেমন উৎপাদন করেন, অপরদিকে নিজেদের মজুরি দিয়ে পণ্য কিনে নিয়ে ভোগ করেন।

অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী প্রতিবছরই মুদ্রাস্ফীতি হয়। দ্রব্যের মূল্য বাড়ে। বাংলাদেশে তো যেকোনো অজুহাতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কাচাবাজারে শাকসবজি, তরিতরকারি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধের দাম বৃদ্ধির ঘটনা তো আছেই। একইসঙ্গে আছে বাসাভাড়া, পরিবহন, শিক্ষা খরচ বৃদ্ধি পাওয়া। মজুরি যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, সমস্ত জিনিসের দাম যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে শ্রমিক প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় নিম্নমানের জীবনযাপন করতে বাধ্য হবেন। যেমন সরকারি হিসাব অনুযায়ী আমাদের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সরকারি হিসাবে, গত বছর যে জিনিসের দাম ১০০ টাকা ছিলো, আজকে জিনিসের দাম ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা। শ্রমিকেরা যদি ১০০ টাকার জায়গায় ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা পান, তাহলে তিনি গত বছরের সমান জায়গা থাকবেন। আর যদি কম মজুরি পান, তাহলে গত বছরের চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকবেন।

দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। ফলে শ্রমিকেরা যা খান, সেই খাবারের দাম যদি ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, আর শ্রমিকের বেতন যদি না বাড়ে, তাহলে তিনি অপুষ্টিতে ভুগবেন। অপুষ্টিতে ভোগা শ্রমিক উৎপাদন ভালো করতে পারবেন না। ভালো উৎপাদন করতে না পারলে দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায়ও তার একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। কারণ শ্রমিক জিনিস কেনেন বাজার থেকে। যে মালিকেরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেন, তারা বিদেশি কিনবেন, বিদেশে গিয়ে বাজার করেন। দেশে ৭ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমশক্তি। শ্রমিকেরা জমি, কারখানা, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিকতায়, চিকিৎসাসেবায় যুক্ত থেকে তারা কেবল উৎপাদনই করেন না, ভোগও করেন। ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া মানে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে যাওয়া। ফলে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি অত্যাবশক এজন্য যে, যেহেতু দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে, যেহেতু সরকারি ঘোষণায় বেসরকারি মালিকদের স্বার্থে দ্রব্যের মূল্য ক্রমাগত বাড়ছে, ফলে দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির সঙ্গে জীবনমানের সমন্বয় করতে চান, বেতন বৃদ্ধি না করলে শ্রমিকদের জীবনমান ক্রমাগত নিম্নমুখী হতে থাকবে। এর নেতিবাচক পড়বে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও। কারণ শ্রমিকের মজুরি কেবল নিজের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্যই।

দারিদ্রসীমার উপরে উঠতে গেলে একজন মানুষের কতোটুকু আয় করতে হয় তার একটি মাপকাঠি আছে। সুস্থ-সবল জীবন যাপনের জন্য দৈনিক কতো ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, তার একটি মাপকাঠি আছে। মানসম্পন্ন একটি বাসায় থাকতে গেলে কী পরিমাণ ভাড়া লাগে, সেটাও আমরা বাজার থেকে জানি। একজন শ্রমজীবী মানুষ, যদি তিনি মানসম্পন্ন জীবন যাপন করতে চান, তাহলে ২৪ হাজার টাকার নীচে মাসিক বেতন হলে তা কোনোভাবেই ন্যায্য হয় না। ফলে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের দাবি হচ্ছেÑউৎপাদিত শক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম, পোশাকদ্রব্য উৎপাদন করে যে সমস্ত দেশে, সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের শ্রমিকের মজুরির তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ, দেশের শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজন কতোটুকু করেন, শ্রমিক ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ হয়ে ওঠা, বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তাÑসবকিছু বিবেচনা করলে ২৪ হাজার টাকার নীচে মাসিক বেতন দিয়ে শ্রমিকেরা কোনোভাবেই মানসম্পন্ন জীবন যাপন করতে পারবেন না।

দেশের শ্রমজীবী মানুষেরা মনে করেন যে তার যৌবনের শক্তি দিয়ে তিনি কাজ করেন, বৃদ্ধ বয়সে তাকে দেখবে কে? ফলে সর্বজনীন পেনশনের একটা ঘোষণা দেওয়া আছে। কিন্তু এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? তার রূপরেখা এখনো পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এই পেনশনের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে জমা দিলে আঠারো-বিশ বছরের পর যেটা পাবে, সেটা কি গার্মেন্টেসের সকল শ্রমিকদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে? কারণ তার চাকরি তো অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে! যেকোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে। ফলে ধারাবাহিকভাবে, নিয়মিত পেনশনের টাকা জমা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়াতে হবে। এবং একটা বিবেচনা করতে হবে যে, কেন শ্রমিকেরা তাদের সর্বজনীন পেনশনের জন্য নিয়মিত টাকা দিতে পারবেন না, তার কারণগুলো কীÑ সেসব দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।

বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাদের কাজ থাকে না ঠিকমতো। মজুরিও নির্ধারণ হয় না ঠিকমতো। তাদের নিয়োগপত্র, পরিচত্র নেই। নারী-পুরুষের শ্রম ও মজুরির মধ্যে বৈষম্য আছে। ফলে কর্মক্ষেত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়ার কারণে শ্রমিকদের জীবনের দুর্দশাটা আরও বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানি-অপ্রাতিষ্ঠানিক মজুরির ক্ষেত্রে একটা সাধারণ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার দাবি করেছেন শ্রমিকেরা।

দেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি যেমন এখানে যুক্ত আছে, পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। কারণ সমাজ কাঠামো ও মানসিকতা অনুযায়ী নারী শ্রমিকেরা প্রতিনিয়তই তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা দরকার। যে আইন দিয়ে নারী শ্রমিকেরা ভাববেন, তাদের কর্মক্ষেত্র নিরাপদ। পথে চলতেও নিরাপদ বোধ করবেন। ফলে কর্মপরিবেশ নিরাপদ না হলে মানসম্পন্ন বা দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক পাওয়া যাবে না। যদি আমরা দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক পেতে চাই, যদি আমরা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবন পেতে চাই, তাহলে শ্রমিকদের জীবনকেও নিরাপদ করতে হবে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দক্ষতা বাড়ে না। নারী শ্রমিকদের জন্য সহিংসতামুক্ত ও হয়ারানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও উঠছে।

বাংলাদেশ শ্রমজীবী মানুষের দেশ। শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নত হলে বাংলাদেশও উন্নত হবে। তা না হলে একদিকে শ্রমিকেরা শোষিত হতে থাকবেন, অন্য দিকে সমাজে বৈষম্য বাড়তে থাকবে। শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই মে দিবসের আবির্ভাব হয়েছিলো। ১৩৭ বছর ধরে শ্রমিকেরা লড়ছেন। এবারও শ্রমিকেরা সেই প্রতিজ্ঞাই নেবেন, বৈষম্যে ও শোষণের সমাজ পাল্টাতে হবে। শ্রমিক যেন শ্রম দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন, সেই রকম একটা জীবনের দাবিতে শ্রমিকদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।

শেয়ার করুন