ডেস্ক রিপোর্ট

২৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩:০১ অপরাহ্ণ

রাজনীতির চাপ আর অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

আপডেট টাইম : অক্টোবর ২৮, ২০২৪ ৩:০১ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন :

অভ্যুত্থানের আগে এবং পরের পরিস্থিতি এক থাকে না। অভ্যুত্থান শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রে ধাক্কা দেয় তা নয়, আলোড়ন তোলে চিন্তার জগতেও। অভ্যুত্থান একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে প্রাথমিক বিজয় অর্জন করা গেলেও বিজয় ধরে রাখা খুব কঠিন। বাংলাদেশেও বারবার সেটাই হয়েছে। জনগণ জীবন ও রক্ত দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনে কিন্তু ক্ষমতায় যারা আসে তারা জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সুবিচার করে নাই। এবারও কি তাই হবে? অভ্যুত্থানের আগে ছিল গণতন্ত্রের আশায় প্রাণপণ লড়াই আর এখন আছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা আর প্রতীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তনের দিন। ১৫ বছরের একটানা শাসন শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বিষয় ছিল না, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশ ও জনগণকে এবং যার প্রভাব রাজনীতিতে থাকবে আরও বহুদিন। দেশের প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন, সংসদ নেই, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিতর্ক চলছে। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসেনি কখনো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী করবে, কীভাবে করবে, কত দিনে করবে সেসব নিয়ে যেমন জিজ্ঞাসা আছে তেমনি আছে নানা সন্দেহ ও বিতর্কের ধূম্রজাল।

এর মধ্যেই আবার প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে এই দাবিতে শুরু হয়েছে আন্দোলন। স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়কালের প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস ও আস্থায় নেওয়া যায় না, এই যুক্তিতে তাকে সরানোর কথা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার সাক্ষাৎকার প্রচারের মধ্য দিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কী করেন নাই এই বিতর্ক তোলা হচ্ছে। যদিও এই বিতর্ক এখন আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেছেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সংসদ সদস্যরা পলাতক বা কারারুদ্ধ, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, ডেপুটি স্পিকার কারাগারে, ফলে পদত্যাগ বিতর্ক এখন আর প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন উত্তরবিহীনভাবে ঘুরছে বাতাসে, এটা কি রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকার না আলাপচারিতা? সাক্ষাৎকার দিলে তিনি কি ৫ আগস্টের কথা ভুলে গেলেন? আর যদি আলাপচারিতা হয় তাহলে তা বাইরে প্রকাশিত হলো কেন?

একদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তেজনা, অন্যদিকে অর্থনীতিতে বিরাজ করছে সংকট। ধারণা করা হচ্ছে কোভিড মহামারীর পর সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে চলতি অর্থবছরে। বিশ্বব্যাংক এই পূর্বাভাস দিয়েছে আর সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছে যে, দেশের অর্থনীতি এখনো গতি ফিরে পায়নি কিন্তু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী গতিতেই আছে। অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে, গত কয়েক মাসে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও ধীরগতি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নানা জটিলতায় অর্থনীতিতে যেসব অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সেগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।

১০ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এটিও একটি গড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস মাত্র। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি যদি ঠিকমতো না চলে তাহলে প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, অর্থনীতির খাতগুলো খুব ভালো করলে প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশের অর্থনীতি দুর্বল ও গতিহীন হয়ে পড়ার যেসব লক্ষণ ও প্রবণতা চলছে সে ধারা অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী তলানিতে গিয়ে ঠেকবে এবং তা দাঁড়াবে কোভিডের সময়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম। করোনোভাইরাস মহামারীর সবচেয়ে খারাপ সময়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কোভিড সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও উৎপাদন, সেবা খাত ও মানুষের চলাফেরায় বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এ কারণে কৃষি ছাড়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদন কর্মকাণ্ড। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নয়, এক কথায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। এখন তো সে অবস্থা নয় তাহলে কেন স্থবির হবে অর্থনীতি? এ এক জটিল প্রশ্ন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক নিয়ামক হতে পারে দুটি বিষয়। একটি অনিশ্চয়তা আর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একটি রাজনৈতিক অন্যটি প্রাকৃতিক। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে। অন্য বিষয়টি হলো দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যা, যা কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সীমিত করে দিয়েছে। এই দুই কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে কমবে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

ব্যবসায়ীবান্ধব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও মুনাফার নিশ্চয়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তা দেখলে বিনিয়োগের পথে না হেঁটে হাত গুটিয়ে বসে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিশ্চয়তা বাড়ায়। এটা নিরসনের জন্য সরকারের চেষ্টা ও পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যার কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা।

ফলে অর্থনীতির এই দুর্বলতা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার অতিরঞ্জিত হিসাব করে জিডিপি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এই হিসাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছিল সে সময়ই। তাদের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্লথ হতে শুরু করে, যে ধারা এখন আরেকটু বাড়বে। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে নজর রাখলে দেখা যাচ্ছে টানা তিন মাস ধরেই সংকোচনের ধারায় রয়েছে অর্থনীতি। অর্থনীতির মূল চারটি খাতের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয় কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাত। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে কেবল উৎপাদন খাত সম্প্রসারণের ধারায় ফিরেছে। বাকি তিনটি খাত সংকোচনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধির হিসাবে গরমিলের কারণে অর্থনীতিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে অর্থনীতির অবস্থা বেশ খারাপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।

এটা তো স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই সীমিত খাত নির্ভর। অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাত রাইস (চাল অর্থাৎ কৃষি), রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) ও আরএমজি (তৈরি পোশাক)। এর সব কটিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে পুঁজির ব্যবস্থা অর্থাৎ সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে সারের যাতে ঘাটতি না ১হয় এবং সময় মতো পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাত প্রবাসী কর্মীদের বিদেশ গমন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।

এ মাসের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাংকের ‘বিজনেস রেডি’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এটি মূলত ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ‘সহজে ব্যবসার সূচক’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বিকল্প। কোনো দেশে কোনো কোম্পানির কাজ শুরু করা, পরিচালনা ও বন্ধ করা এবং প্রতিযোগিতার কাজের ধরন পরিবর্তনের মতো ১০টি বিষয়ের ভিত্তিতে নতুন প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ কিন্তু খুব ভালো অবস্থানে নেই।

আবার বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, যা কিছুটা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিস্থ খাতের চাপ, যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে হবে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বাড়ছেই। এক্ষেত্রে যদি অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় এবং প্রকৃতি বিরূপ না হয় তাহলে চলতি অর্থবছরে হয়তো ৫ শতাংশের একটু বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কখনই সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী হয় না, তা যতই সূক্ষ্মভাবে করা হোক না কেন। কারণ সরকারের থাকে রাজনৈতিক প্রচারণা আর অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে নানা প্রভাবক। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ। এই জনগণ বন্যা, খরা, মহামারী মোকাবিলা করে টিকে থাকে। জনগণের টিকে থাকার শক্তির সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা যুক্ত হলে সাম্প্রতিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা কঠিন নয়। ক্ষুদ্র মাঝারি অর্থনীতির যে অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে, তাকে ব্যবহার করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। বৈষম্যমূলক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে সমাজের বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রামকে বেগবান করতেই হবে।

যেকোনো ব্যর্থতাই শিক্ষা রেখে যায়। তাই বর্তমান অর্থবছরের সমস্যাগুলো দেখে শিক্ষা নিলে শুধু অর্থনীতিতে আবার চাঙা ভাব ফিরে আসবে তা নয় শ্রমজীবী জনগণের জীবনেও স্বস্তি আসবে। দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, লুটপাট বন্ধ হবে এই আশা করা শুধু যুক্তিসঙ্গতই নয়, এই মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজন।

জনগণ রাজনৈতিক পরিবর্তন চায় কিন্তু সবার আগে চায় নিজের জীবনধারণের নিশ্চয়তা ও জনজীবনে স্বস্তি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উন্নত হবে না। সংস্কার যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন না করে নানা ইস্যু সামনে এনে মানুষের নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজ করলে জনমনে সন্দেহ ও অসন্তোষ বাড়বে। ফলে এই তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। কারণ মানুষ শুধু ক্ষমতার হাত বদল চায়নি, চেয়েছিল ব্যবস্থার বদল। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ করা ছাড়া অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে না।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন