ডেস্ক রিপোর্ট

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

মূল্যবৃদ্ধির জরিপ ও বাস্তবতা

আপডেট টাইম : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন: দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের মনোভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত জরিপ হচ্ছে এবং ফলাও করে প্রচার হচ্ছে জরিপের ফল। দেশে এবং বিদেশে জরিপ নিয়ে নানা মুখরোচক কথা চালু আছে। কৌতুক আছে পরিসংখ্যান নিয়ে। কারণ মানুষ বাস্তবে যা দেখে, তা সবসময় জরিপে বা পরিসংখ্যানে উঠে আসে না। যেমন একটা কৌতুক আছে এ রকম যে শার্লক হোমস এবং তার গোয়েন্দা সঙ্গী ডা. ওয়াটসন বনের ধারে তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে আছেন। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শার্লক হোমস ওয়াটসনকে জিজ্ঞেস করলেন, আকাশের দিকে তাকাও। কিছু দেখতে পাচ্ছ কি? ওয়াটসন খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বললেন, পাচ্ছি। কী দেখতে পাচ্ছ? হোমসের প্রশ্ন। ওয়াটসন বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি আকাশ জুড়ে লাখ লাখ তারা। এর মানে কী? হোমস জানতে চাইলেন। ওয়াটসন বললেন, আবহাওয়াবিদের দৃষ্টিতে দেখলে আগামীকাল রোদ হবে, দার্শনিকের দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, এই বিশাল মহাকাশের তুলনায় আমরা কত ছোট।

হোমস চুপ করে আছেন দেখে ওয়াটসন জানতে চাইলেন, আপনি কী দেখছেন? গম্ভীর হোমস বললেন, ‘দেখছি তাঁবুটা নেই। আমরা যে তাঁবুটাতে ছিলাম কোনো এক চোর সেটা চুরি করে নিয়ে গেছে।’ আসলেই অনেক ক্ষেত্রে আমরা দূরের তারা গুনি, কিন্তু মাথার ওপরের তাঁবুটা যে চুরি হয়ে গেছে সেটা খেয়াল করি না। জরিপে তেমনি দূরের মানুষের সমস্যার কথা উঠে আসে। কিন্তু চোখ মেলে তাকালেই তো দেখতে পাওয়া যায় কী সমস্যায় ডুবে আছে মানুষ, ডুবে আছি আমরা। এর জন্য কি জরিপ লাগে?

তারপরও জরিপ করা হয়। প্রতিটি আলাদা ব্যক্তি মানুষের সমস্যাকে সমষ্টিগত সাধারণরূপে প্রকাশ করার জন্য। এর ফলে একটা গড় চিত্র পাওয়া যায়, কিন্তু গড় চিত্র দিয়ে ব্যক্তিগত সংকট দূর করা যায় না। যেমন ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন মানুষ ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করছেন। ঢাকার অধিবাসীর তুলনায় এটা কত শতাংশ? এই শতাংশের হিসাবে কি মৃত্যুর বেদনা, সংকটের ভয়াবহতা, চিকিৎসার দুরবস্থা, মানুষের আতঙ্ক প্রকাশ করা যাবে? কেন ডেঙ্গু রোগীকে তরল খাওয়াতে হবে এ কারণে ডাব এবং স্যালাইনের দাম বহুগুণ বেড়ে যায়?

কারা বাড়িয়ে দিল এই দাম কিংবা কেন তারা ডাব লুকিয়ে রাখে দাম বাড়ানোর জন্য? ডিমের দাম কেন শ্রমজীবী মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, আলু কৃষক বিক্রি করেন ১০ টাকা কেজি আর দুই মাস পরেই বাজারে তার দাম হয়ে যায় ৩৫ টাকা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা তো বটেই, কাঁচা মরিচ কেন কখনো কখনো হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়? এসবের উত্তর সব জরিপ থেকে পাওয়া যাবে না। উত্তর খুঁজতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি আর ব্যবসায়ীদের রাজনীতিকরণের বিষয় খেয়াল করতে হবে। এর শিকড় আছে গভীরে, কিন্তু প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

যেমন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দেশের অর্থনীতি যে ভালো নেই, সেটা তিনি নিজের জীবন থেকেই উপলব্ধি করে বলেছেন, ‘অর্থনীতি বড়দের ব্যাপার, সেটা ভালো বুঝি না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করার পরও আমার অর্থনৈতিক অবস্থা দুই বছরে আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। বেতন যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। দুটি সেভিংস ছিল, ভেঙে ফেলতে হয়েছে। আশপাশের অন্যদের অবস্থাও তো ভালো না। আমার এক বন্ধু এলসি খোলার জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ঘোরে, এলসি খুলতে পারছে না। আমাদের মতো যাদের অবৈধ উপার্জন নেই, তাদের জন্য সংসার চালানো, তিন বেলা ডাল-ভাত খাওয়াই কষ্টকর হয়ে উঠছে।’ এ ধরনের কর্মকর্তারা ৪০-৫০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। তারপরও তার এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু আছে কি? আর যাদের আয় ১৫ হাজার টাকা তাদের জীবন চলছে কেমন করে?

একটা জরিপে উঠে এসেছে ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে চলছে না এবং এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আয় না বাড়া আর শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি। ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বলে ওঠেন, এসব বানানো কথা। বাজারে প্রচুর জিনিস আছে, কোনো সংকট নেই। মানুষের আয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে কিনা, তিনটি পক্ষ তা ভালোমতো বুঝতে পারছেন।

প্রথম পক্ষ হলেন দেশের জনগণ, তারা সংখ্যায় বেশি এবং তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আয় না বাড়ার কারণে তাদের খাওয়া কমাতে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পক্ষ হলেন ব্যবসায়ীরা, যারা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছেন না, আমদানি হচ্ছে না, ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।

আর তৃতীয় পক্ষ হলেন সরকারি কর্মকর্তারা। কারণ তারা দেখছেন রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি আটকানো যাচ্ছে না, ক্রমাগত বাড়ছে। এসব তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে। তিন পক্ষই তো সমস্যাটা বুঝলেন, কিন্তু সমাধান করবে কোন পক্ষ? সমাধানের উদ্যোগ কিংবা দ্রুত অবসানের তো কোনো লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সমস্যাকে উপেক্ষা করার প্রবণতাই বেশি। তুলনা দেন তারা ইউরোপের সঙ্গে, যুক্তি করেন কোথায় বাড়ছে না জিনিসের দাম? কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলেন, দাম বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। ফলে সমস্যা নেই কোনো। কিন্তু সাধারণ মানুষ বোঝেন, জীবনযাপনের কষ্ট কত বেড়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, সাধারণ মানুষেরা তাদের ব্যক্তিজীবনের আর্থিক চাপ, মূল্যস্ফীতির কারণে ‘অর্থনীতি ভুল পথে’ রয়েছে বলে মন্তব্য করলেও বাস্তবে অর্থনীতির সমস্যাগুলো আরও ব্যাপক। সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ ধনী এবং উচ্চবিত্ত হলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ৭০ লাখ। ৪ জনের পরিবার ধরলে তার সংখ্যাও দাঁড়ায় ৪২ লাখ। অর্থাৎ ৪২ লাখ ধনীর কাছে ট্যাক্স আদায় কি হয়? সাধারণ মানুষের কিন্তু পরোক্ষ করের হাত থেকে রেহাই নেই। খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, সন্তানের শিক্ষা, ব্যাংকের টাকা, যাতায়াত খরচ, মোবাইল ব্যবহার কোথায় নেই ট্যাক্সের হাত? কিন্তু আমাদের রাজস্ব আদায়ের নিম্ন হার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আর বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থা, এমনকি আইএমএফের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে না পারা সব সূচকই তো নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমে যাওয়া আর ডলার হয়ে টাকা পাচার হওয়া তো সমানতালেই চলছে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে এবং মানুষের জীবনে ব্যাপক।

পরিসংখ্যান ব্যুরো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি আগস্ট মাসে ৯.৯২ শতাংশ, জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭৪ শতাংশ, জুলাই মাসে ছিল ৯.৬৯ শতাংশ। ভারতে আগস্ট মাসে ৭ শতাংশ, অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলংকায় ৪ শতাংশ, নেপালের রাষ্ট্র ব্যাংক সূত্রে জানা যায় সেখানে ৬.৮৩ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি কমেছে ইউরোপ, আমেরিকা আর কানাডাতেও। মূল্যস্ফীতির এই হিসাব থাকে খাতায় কিন্তু এর প্রভাব দেখা যায় বাজারে আর সাধারণ মানুষের খাবারের পাতে।

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, শ্রমজীবীদের মজুরি। বাংলাদেশের ৭ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবী মানুষ যাদের ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের নিয়মিত কাজ নেই, মাসিক মজুরি নেই আছে শুধু অনিশ্চয়তা। রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে যে গার্মেন্টস খাত থেকে, সেই খাতের প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ হাজার টাকা ২০১৮ সালে। এই পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্য কত শতাংশ বেড়েছে আর মজুরি কত টাকা বেড়েছে এই প্রশ্নের জবাব কী? অথচ এই শ্রমিকের শ্রম যুক্ত হয়ে গার্মেন্টসে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে।

নানা রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও শ্রমিকের মজুরিতে সর্বনিম্ন। শ্রমিকরা যা খায় আর যা ব্যবহার করে সব কিছুর দাম বাড়ছে, শ্রমিকরা যা উৎপাদন করে তার দাম বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না শ্রমিকের মজুরি। এই শ্রমিকরাই তো উৎপাদন করে, তার ফলে দেশের প্রয়োজন মেটে আর বিদেশে রপ্তানি হয়, আসে বৈদেশিক মুদ্রা। জীবনমান না বাড়লে উন্নয়ন যতই হোক না কেন, তাদের জীবনকে তা স্পর্শ করবে না।

আসলে জরিপ প্রয়োজন প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য, সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য আর সমাধানের পথ বের করার জন্য। একটা সংকট মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে এবং মানুষ সে বিষয়ে কী ভাবে তা জানা খুবই জরুরি। তাই জরিপ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে আর সমস্যাকে উপেক্ষা করে সাময়িক তৃপ্তি পাওয়া যাবে কিন্তু সমস্যার জটিল আবর্ত থেকে বের হওয়া যাবে না। মানুষের কষ্ট নিয়ে উপহাস নয়, সমবেদনা দরকার। দূরের উদাহরণ দেখানো নয়, কাছের সমাধান সূত্র বের করা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার জবাবদিহি।

রাজনীতিতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচনের সময় জনগণ যেন বাছাই করতে পারে তাদের প্রতিনিধিদের আর নির্বাচিত হলে প্রতিনিধিরা যেন শাসক হয়ে না উঠেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশাসনের দুর্বৃত্তপনা, রাজনীতির দুর্র্বৃত্তায়ন বন্ধ কোনো জাদুর মন্ত্রে হবে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিবাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন। দেশের অর্থনৈতিক সংকট যেমন রাজনীতির বাইরে নয়, তেমনি সমাধানটাও খুঁজতে হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন