ডেস্ক রিপোর্ট

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ণ

মব জাস্টিস: মুস্তাক-তিশা দম্পতি!

আপডেট টাইম : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪ ১১:৫৯ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক:
গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও সিনথিয়া ইসলাম তিশা নামের দুজনকে দুয়োধ্বনি দিয়ে অমর একুশে বইমেলা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বের করে দেওয়ার কারণ তাদের বিয়েটা অসম বয়সী। তারা এই বিয়েটা করে না কি অনৈতিক কাজ করেছে! এবং তাদের সেই ভালোবাসার কাহিনী বইয়ে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করায় সেটি হয়েছে আরো গর্হিত অপরাধ!!

বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে এই দম্পতির বিয়ে বৈধ। যে বই দুটির কারণে বইমেলা ঘিরে তাদের সম্পর্কে সমালোচনা সেই বই দুটিকেও কোন কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করে নাই! তাহলে বিষয়টি কি দাড়াঁলো?

একদল উশৃঙ্খল মানুষের দাবির মুখে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্লা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা (আনসার) সেই উশৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত না করে তাদেরকে বইমেলা থেকে নিরাপদে বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। অর্থাৎ কর্তব্যরত আনসার বাহিনীর সদস্যরা এই উশৃঙ্খল জনতার দাবিকে সমর্থন করলো!

যে অনৈতিকতার প্রশ্ন তুলে তাদেরকে মেলা থেকে বের করে দেওয়া হলো, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে এর চেয়েও ভয়াবহ অনেক অনৈতিক এবং বেআইনি ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ সেমস্ত জায়গাগুলিতে এই জনতাকে তাদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না!

সেইসমস্ত ঘটনাগুলিতে তারা তাদের নিজেদেরকে নিরাপদ দূরুত্বে রাখে। যে মব তাদেরকে মেলা থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছে তাদের পারসেপশন হচ্ছে,‘এই দম্পতি আমাদের সমাজে লজ্জাজনক একটি সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করছে। তার উপর বই লিখে ব্যাপারটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্যই সচেতন মানুষগণ তাদেরকে তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিয়েছে ’।
এই দেশে হাজার কোটি টাকা পাঁচার হয়ে যাচ্ছে, লুটপাট হচ্ছে, গুন্ডাতন্ত্র কায়েম হচ্ছে, কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে, তাদের হাতে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসের অভয়রাণ্য তৈরি হচ্ছে, সেখানে কখনও শিক্ষক বা কখনও ছাত্র কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে; সকল ধরণের গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের কাছে এই একটি বিষয়ও লজ্জাজনক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করছেনা!

কারণ এই সমস্ত কোন বিষয়ে তাদেরকে না কথা বলতে শোনা যায়; না রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়!সেটা প্রত্যাশাও করাও অবশ্য ঠিক না! তারা শুধুমাত্র সিলেক্টিভ কিছু বিষয়কে সামনে এনে অরাজক একটি পরিস্থিতি তৈরি করে!

এটি একটি চক্র; যে চক্রের কাজ এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত করা, মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করে দেয়া। সমাজে একধরণের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করা। যাতে মানুষের চিন্তার বনসাইকরণ ঘটে।

খুবই সাধারণ দম্পতি মোস্তাক-তিশা! তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে ভাইরাল করে তোলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে! ইউটিউবাররা বিষয়টিকে উপজীব্য করে নানাধরণের কাহিনী তৈরি করেছে। সেই কাহিনী দেখার একটি উল্লেখযোগ্য দর্শক এই মব! এই ধরণের বিষয়কে সামনে এনে বাণিজ্য করে নিচ্ছে একটি অংশ।
এই যে সমাজের মধ্যে যা ঘটছে এটি আদোতে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। আমরা বিচ্ছিন্ন করে দেখছি বলেই বারংবার এই ধরণের ঘটনা ঘটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যে পরিস্থিতি তৈরি করে মুস্তাক-তিশাকে বইমেলা থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে তাকে বলে মব জাস্টিস।

মব শব্দটির অর্থ হুজুগে জনতা। এই হুজুগে জনতা দ্বারা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বিচার হওয়াটাকেই বলা হয় মব জাস্টিস। এসব ক্ষেত্রে জনতার আচরণ শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুসংগঠিত হয়না। ব্লুমার (Blumer) জনতাকে চার ভাগে ভাগ করেছেন: আকস্মিক জনতা (casual crowd), রীতিগত জনতা (conventional crowd), সক্রিয় জনতা (active crowd) ও অভিব্যক্তিপূর্ণ জনতা (expressive crowd) ।

এই জনতার কিছু বৈশিষ্ট্যে রয়েছে। এদের মধ্যে মানসিক সমরুপতা কাজ করে। শিক্ষা, বুদ্ধি অথবা পেশার ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যেহেতু জনতার এক অভিন্ন লক্ষ্যবস্তু থাকে সে কারণে জনতার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের প্রতিক্রিয়াও সমরূপ হয়।

ব্যাপকভাবে আবেগপ্রবণতা কাজ করে। আদিম প্রবৃত্তি ও আবেগ জনতার মধ্যে প্রকাশ পায়। এই অতিরিক্ত আবেগের কারণে জনতা খুব সহজেই হিংসাত্বক কাজে লিপ্ত হতে পারে। জনতার মাঝে ব্যক্তি অন্যান্য সদস্যের আবেগ-আপ্লুত আচরণ দেখে নিজেও আবেগদীপ্ত হয়ে পড়ে৷

এই জনতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিচারশক্তিহীনতা। জনতার মাঝে ব্যক্তি বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে৷ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সম্ভব-অসম্ভব প্রভৃতি বোধ লোপ পায়। তখন ব্যক্তি যা শোনে তাই বিশ্বাস করে। যুক্তিতর্কের নিরিখে শ্রুত তথ্যের যাচাই করার ক্ষমতা ব্যক্তির থাকেনা। ব্যক্তি অপরিণামদর্শী হয়ে পড়ে এবং ফলাফলের কথা না ভেবেই যে কোন প্রকার কার্যে লিপ্ত হয় ৷

তাদের মধ্যে সকল প্রকার দায়িত্ববোধর অবনতি ঘটে। দায়িত্ববোধের অভাব থাকায় জনতাভুক্ত ব্যক্তিরা অন্যের সুবিধা-অসুবিধা, অধিকার, অনুভূতি প্রভৃতি কোন কিছুর ধার ধারে না৷ এই জনতার মধ্যে কোন প্রকার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সে যা ইচ্ছা তাই করে।এদের আরো একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য নিজেদেরকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। তাদের বাঁধা দিতে পারে এমন কোন শক্তিও তারা স্বীকার করে না৷ ফলশ্রুতিতে তাদেরকে প্রথম অবস্থায় নিবৃত্ত না করলে সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

জনতার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য আলোচিত হল (মানসিক সমরূপতা, আবেগপ্রবণতা, বিচারশক্তিহীনতা, দায়িত্ববোধের অবনতি, ক্ষমতাবাধ প্রভৃতি) তার মূলে যে উপাদান কাজ করে তা হল অনামিত্ববোধ ৷ অর্থাৎ সে মনে করে সে একা এই কাজের জন্য দায়ি না। গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সবাই দায়ি। সুতরাং তার কিছুই হবেনা। তাছাড়া সে মনে করে ভিড়ের মধ্যে তাকে চিনবেই বা কে৷ নাম-ধাম, পরিচয় গোপন থাকার সুযোগ যেখানে রয়েছে সেখানে উচ্ছৃঙ্খল হতে বাঁধা কোথায়?
মব যে সবসময় ডেসট্রাকটিভ সেটি নয়, কখনও কখনও এটা উপকারী হতে পারে। কিন্তু মব সবসময়ই অনেক বেশি আবেগী, যুক্তিহীন ও দায়িত্বহীন। এদের উপরি উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে অস্বীকার করা যায় না, তা তারা যতই ভাল কাজ করুক না কেন।

আপনার কাছে চুরি, ধর্ষণ অপরাধ, কিন্তু আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যে লোকটি মবে অংশগ্রহণ করছে তার কাছে হয়তো শুধু এগুলোই অপরাধ নয়, পাবলিক প্লেসে কিস করা তার কাছে অপরাধ, ধর্মের সাধারণ সমালোচনা করা অপরাধ, মুক্তচিন্তা করা অপরাধ। চূড়ান্তভাবে তারা কিন্তু এই অপরাধগুলোর জন্যই উত্তেজিত হয়ে মব এ ভুমিকা রাখতে পারে।
এটা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এই সংস্কৃতির কিছু কাজ আপাতভাবে ইতিবাচক মনে হলেও এটা শেষপর্যন্ত সমাজের জন্য ক্ষতিই বয়ে আনে।

আমার এখানে এই আলোচনা করার প্রেক্ষিত হচ্ছে, এই মব প্ররোচিত হয়ে থাকে একটি সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী কর্তৃক। এই অংশটি মবকে প্ররোচিত করে নিরাপদ দূরুত্বে অবস্থান করে ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।যে সমাজে আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকে সেখানেই মব জাস্টিস এর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বইমেলাটিতে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি একটি মব জাস্টিস হয়েছে। আর এটি পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী করেছে।

যে গোষ্ঠী এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা,মুক্তচিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়; ধর্ম অবমানার দাবী তুলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চায়; সমাজের মধ্যে অবাধ লুটপাট জারি রাখতে চায়, আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে বাধাগ্রস্থ করতে চায়; এই কাজটি তাদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে।

এরাই কৌশলে পহেলা বৈশাখ পালন করা নিয়ে বির্তক তৈরি করে, বাঙালী সংস্কৃতিকে ধর্মের চাদরে ঢেকে দিতে চায়! এরাই মুশতাক-তিশা দম্পতির ভিডিও দেখে, ডা: সাবরিনার ভিডিও দেখে; তাদের সাথে সেলফিও তুলে! রাতের বিছানাতে এদের কথা ভেবে শারিরীক পুলকও অনুভব করে!

আর দিনের বেলায় সাধারন জনগনকে ডেসট্রাক্টিভ মবে পরিণত করে।

সবচেয়ে পরিতাপের জায়গা হলো, সরকারী পর্যায়ে এরা পৃষ্টপোষকতা পেয়ে থাকে। যার কারণে দিনের পর দিন বাংলাদেশ নামক মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয়া একটি রাষ্ট্রে এই ধরণের ঘটনা সংঘটিত করার সুযোগ পায়।
ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সমাজের মধ্যে আজকে যে ভোগবাদী প্রবণতা, অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে তার উৎস বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা। একটি মানবিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

শেয়ার করুন