ডেস্ক রিপোর্ট

৪ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৫৯ অপরাহ্ণ

বুয়েটের সাম্প্রতিক উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে ছাত্র ফ্রন্টের বক্তব্য

আপডেট টাইম : এপ্রিল ৪, ২০২৪ ৩:৫৯ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

অধিকার ডেস্ক: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন আজ ৩ এপ্রিল ২০২৪ সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের যাওয়াকে কেন্দ্র করে একটা পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়।

শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে এবং বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি চলবে না বলে তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্র লীগের সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে তখন সাধারণ ছাত্ররা সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের বিরুদ্ধে হত্যার বিচোরের দাবিতে আন্দোলনে নামে। এক পর্যায়ে ছাত্ররা দাবি জানায় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। একদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আপাত প্রশমিত করে এবং সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের সেফ এক্সিট তৈরি করে। কয়েকদিন আগে ছাত্র লীগ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে পুনরায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে একই দাবি জানায়।

দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে অর্জিত ছাত্র রাজনীতিকে শাসক শ্রেণির দলসমূহ কলুষিত করে আসছে। একদিকে রাজনীতির উপর ছাত্র সমাজের বিরূপ ধারণা তৈরি করছে, অন্যদিকে তাদের স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য আদালতকেও ব্যবহার করেছে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চলার ঘোষণা দিয়ে। এতোদিন নীরব থেকে কেন ছাত্র লীগ ঘটা করে ক্যাম্পাসে গেল তার কারণ হিসেবে সামনেই বুয়েটে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে সে কথা আমরা জানতে পারি। অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বুয়েটের এসকল উন্নয়ন প্রকল্পে নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা নিশ্চিত করতেই ছাত্রলীগের বর্তমান এই তৎপরতা বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আবার হাইকোর্টও যেভাবে রিট হওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে রকেটের গতিতে ইতিপূর্বে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রজ্ঞাপন স্থগিত করার সিদ্ধান্তও জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালুর মন্তব্যের পরই হাইকোর্টের এই রায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার চিত্রকেও আরেকবার দেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত করলো। আবার বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ যে রকম ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক শিবির কিংবা হিজবুত তাহরীর বলে প্রচার চালাচ্ছে তা তাদের পুরানো ঘৃণ্য অপকৌশল ছাড়া কিছুই নয়। শাসক শ্রেণি ও সরকারের অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যেকোন আন্দোলনকেই এইভাবে শিবির বলে ট্যাগ করা বাস্তবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিরই অপকৌশল।

২০১০ সালে ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে তৎকালীন বুয়েট শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট’র আহ্বায়ককে অমানবিক হামলার শিকার হতে হয়েছিলো। ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আবরার হত্যাকাণ্ডের অর্ধযুগেরও বেশি সময় আগে থেকেই অন্যান্য বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়ে ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলো ছাত্রলীগ। বাম প্রগতিশীল রাজনীতির এই শূন্যতা ও সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলদারিত্বের বলি হতে হয়েছে আবরার ফাহাদকে। আবরার হত্যার পরপরই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে আমরা সেই বিক্ষোভে সর্বাত্মকভাবে অংশ নিই। সেই আন্দোলনের মধ্যে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব বিরোধী যে স্পিরিট ছিল আমরা তার সাথে একমত ছিলাম কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অংশ দাবি তোলেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। তখনই আমরা বলেছিলাম ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। একটা দীর্ঘসময় ধরে ছাত্ররাজনীতি বলতে সাম্প্রদায়িক ছাত্র শিবিরের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া, ছাত্রদলের সন্ত্রাস এবং ছাত্রলীগের র‍্যাগিং, দখলদারিত্ব, তোলাবাজি, সীট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, জোরপূর্বক মিছিল-মিটিং এ অংশ নেওয়ানো, গণরুম, গেস্ট রুম ইত্যাদি চলে আসছে। এসব দেখে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ ছাত্র সমাজের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। যেটা শাসকশ্রেণিই দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছে। শিক্ষার্থীরাও শাসকদের এই অপকৌশল বুঝতে না পেরে আপাত সমাধান হিসেবে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছে। যা বুমেরাং হিসেবে বুয়েটের সংকটকে আরও গভীর করবে। আমরা তখন আরও বলেছিলাম বুয়েটেই ছাত্রদলের দুই গ্রুপের কোন্দলে শিক্ষার্থী সাবেকুন্নাহার সনির মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। আজও তাই সন্ত্রাসের দায় ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতির ওপর না দিয়ে যে রাজনীতি সন্ত্রাসের জন্ম দেয় এবং যে সংগঠন সন্ত্রাস করে ও এর মদদদাতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা, সুস্থ্য ও আদর্শবাদী ছাত্র রাজনীতির ধারাকে শক্তিশালী করা ছিল সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু বুয়েট প্রশাসন এই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগালো শিক্ষার্থীদের দাবির কথা আওড়ে তারা ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। আমরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। সেই সময় ‘ছাত্ররাজনীতি নয় সন্ত্রাস বন্ধ করুন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে প্রচারের মধ্য দিয়ে আমরা এই আহ্বান রেখেছিলাম ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের দায় ছাত্র রাজনীতির নয়; তাদের রাজনীতির নামে বুর্জোয়া শ্রেণির এই ‘অপরাজনীতিই’ রাজনীতির একমাত্র চিত্র নয় কিন্তু ঐটাই যে একমাত্র ছাত্র রাজনীতি না, ছাত্র রাজনীতি মানে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর ১১ দফা, গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার ঘোষণা, স্বাধীনতাত্তোর সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ তা শাসক শ্রেণি ছাত্র জনতাকে ভুলিয়ে দিতে চায়। সংগঠিত প্রতিরোধই পারে ছাত্রলীগসহ সকল ধরনের সন্ত্রাস প্রতিহত করতে৷

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, আজকের সময়ে এসে ছাত্ররাজনীতির গুণগত মান ধ্বসে গিয়েছে, দলীয় লেজুরবৃত্তি থেকে ছাত্র রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে ইত্যাদি বলে যে ধরনের কথা আলোচনায় এসেছে তার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই কোনো ছাত্র সংঠনের রাজনীতি কীরূপ হবে তা নির্ধারিত হয় ওই সংগঠন কোন মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করছে এবং কোন শ্রেণির রাজনৈতিক দলের গাইডেন্সে তা পরিচালিত হচ্ছে তার শ্রেণিগত চরিত্র দ্বারা। আজকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগ মুনাফালিপ্সু-লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত একটি দল। অন্যায়-জবদস্তি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও কেন্দ্রীভূত করার পাহারাদার হলো আওয়ামীলীগ। আর ছাত্রলীগ হলো তার সহায়ক পেটোয়া বাহিনী। ক্যাম্পাসগুলিতে ভিন্ন মত ও দলের উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই শোষণ ও লুটপাটের পথকে প্রশস্ত করাই শাসক শ্রেণির ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনীতি। এর বিপরীতের রাজনীতি হচ্ছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ, শিক্ষা সংকোচনসহ ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ আপামর মানুষের সংকট নিরসনের দাবিতে পরিচালিত রাজনীতি অর্থাৎ শোষণ-বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কিত যে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আবরারকে জীবন দিতে হয়েছিল সেটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। একটি প্রশ্ন করার জন্য কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা খুবই পীড়াদায়ক। এ থেকে বুঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয় হলো ছাত্র সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখানো কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার মানুষকে প্রশ্ন করতে দেয় না। বাক স্বাধীনতা হরণ করে। ফলে বাক স্বাধীনতা হরণকারী সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সচেতন ও সংগঠিত উপায়ে সকল প্রকার সন্ত্রাসী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজ সময়ের দাবি। পাকিস্তানি পরাধীন আমলে ‘এনএসএফ’ ও স্বাধীন দেশে স্বৈরাচারী এরশাদের ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’র বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ইতিহাস আমাদের সেই পথ দেখিয়েছিল। শিক্ষার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট দীর্ঘসময় ধরেই সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত স্বায়ত্বশাসিত গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য অব্যাহতভাবে লড়ছে। তাই শাসকশ্রেণির রাজনীতির চিত্র দেখে ভীতসন্ত্রস্ত কিংবা বিমুখতা নয়, সুস্থ্য ও আদর্শভিত্তিক পাল্টা রাজনৈতিক শক্তিই পরিত্রাণের পথ তৈরি করবে। দেশের আপামর ছাত্রসমাজের কাছে সেই সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আহ্বান থাকছে।

নেতৃবৃন্দ একই সাথে বুয়েটসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন অধিকার নিশ্চিত এবং অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ শিক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

শেয়ার করুন