ডেস্ক রিপোর্ট
৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:১৪ অপরাহ্ণ
মোজাম্মেল হক তারা:
হাসান ভাইয়ের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় ১৯৮৫ কি ৮৬ সালে। কিন্তু আগেই তার সম্পর্কে বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি। বোধ করি ১৯৭৭ সন, নোয়াখালীতে গিয়েছিলাম নবগঠিত ছাত্র সংগঠনের প্রাথমিক কমিটি গড়ার উদ্দেশ্যে। চরাঞ্চলসহ জেলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। সাথে গাইড হিসেবে সরজিত দা (পরলোকগত অধ্যাপক সরজিত সেন) এবং কোথাও কোথাও সঙ্গী ভূলন দা (যিনি আজকের এডভোকেট ভূলন চন্দ্র ভৌমিক)। বয়সে নেহায়েত তরুণ হলেও দুজনই এলাকার নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষ। এসময় বিভিন্ন পার্টি বৈঠকে স্থানীয় পার্টির নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস প্রসঙ্গে হাসান ভাইয়ের নাম ঘুরে ফিরে একাধিকবার কানে আসে। আমার ঔস্যুক্যের প্রেক্ষিতে নোয়াখালীর পার্টি কমরেডরা হাসান ভাইকে নিয়ে তাদের স্মৃতি এবং বিভিন্ন রকম গালগল্প করেন। নোয়াখালীর সাধারন মানুষ মাত্রেই স্বভাবে রসিক। ফলে তার কথা বলার ধরন, অঙ্গভঙ্গি, চালচলন ও মুদ্রাদোষ ইত্যাদি নিয়ে রঙ্গ রসিকতায়ও ঘাটতি ছিল না। পার্টি কর্মীদের অধিকাংশই নিতান্ত সাধারণ কৃষক। পক্ষান্তরে নুরুল হাসান হলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের ভাই, পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। উপরন্তু কৃষক কর্মীদের কাছে তিনি শোষণ নিপীড়ন ভিত্তিক প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে কৃষক সমাজের মুক্তির অভূতপুর্ব আশার বাণী ও মার্ক্সবাদী ভিন্ন এক মতাদর্শের বাহক, যার সাথে স্থানীয় অনেকের পূর্বপরিচয় ছিল না। এলাকার লোকজন যদি তাকে বহিরাগত ভিন্ন সংস্কৃতির বিচিত্র এক আগন্তুক হিসেবে গণ্য করে থাকেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
উল্লেখযোগ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যুবক নুরুল হাসান নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুগের রীতি অনুযায়ী সরকারী চাকুরি লাভের চেনা পথ ধরেননি। বরং কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে সাড়া দিয়ে সার্বক্ষণিক পেশাদার বিপ্লবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও তার জানা ছিল এ পথ বিপদসংকুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও সাফল্যের নিশ্চয়তাহীন। পার্টি তাকে নোয়াখালীতে পাঠিয়ে ছিলো স্থানীয় সংগঠনের তত্ত্বাবধান ও কর্মীদের বিপ্লবী মতাদর্শে দীক্ষিত করার জন্য। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে নোয়াখালীর চরাঞ্চলে দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল সেটি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল। যদিও স্বল্পকালের মধ্যেই বিভ্রান্তির মরু পথে সে ধারা গতিরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কমরেড নুরুল হাসান কতদিন নোয়াখালী ছিলেন বলতে পারবো না। তবে নুরুল হাসান সেখানে জনপ্রিয় ছিলেন। যার সূত্র ধরে পরবর্তী জীবনেও তিনি কেন্দ্রীয় পার্টির পক্ষ থেকে নোয়াখালীর পার্টি সংগঠন দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন। হাসান ভাইয়ের লোকপ্রিয়তার কারণ তার ব্যক্তিত্বের ধরন। অভিজাত পরিবারের সন্তান উচ্চ শিক্ষিত এই ‘’ভদ্রলোক’’ সাধারণ “ইতরজন”দের সাথে খুব সহজে মেলামেশা করতেন। কৃষক পরিবারের নিত্যদিনের খাবার ভাগাভাগি করে খেতে তার অরুচি ছিল না। তাদের জীর্ন কুটিরে শীতের মওসুমে রাত কাটানোর কষ্ট উপেক্ষা করা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের বামপন্থি ভাবালুতা, স্বপ্নচারিতা ও বিপ্লবী বুলিবাগীশতা এক জিনিস। আর মধ্যবিত্তের সীমানা দেয়াল ভেঙে গণমানুষের নিত্যদিনের জীবন বরণ করে তাদের মধ্যে মিশে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। নুরুল হাসান এটি পেরেছিলেন।
ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের অন্যতম নেতা ছিলেন নুরুল হাসান। সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রস্তাবিতও হয়েছিল তার নাম। ৬৯-এর ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে। সংগঠনে সার্বক্ষণিক সক্রিয় ছিলেন সারাজীবন। কিন্তু সেই অর্থে রাজনীতিতে তেমন দৃশ্যমান ছিলেন না। জননেতার স্বীকৃতি মেলেনি তার। ছিলেন কিছুটা লোকদৃষ্টির অন্তরালে নেপথ্য সংগঠকের ভূমিকায়। অনুকরণীয় আদর্শ বলে মেনেছিলেন বিপ্লবী নেতা সুখেন্দু দস্তিদারকে, যাকে পার্টিতে সবাই জানতো বশির ভাই নামে। মাষ্টারদা সুর্যসেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের যুবা বাহিনীর সর্বকনিষ্ট সদস্য এই বিপ্লবীর আজীবন আন্দামানে দ্বীপান্তরের সাজা হয়েছিল। আরো অনেক ‘সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী’দের মতো কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হয়ে ছিলেন পরে। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মস্কো-পিকিং দুধারায় বিভাজিত হলে তিনিই ছিলেন নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির সম্পাদক, প্রধান সংগঠক। কিন্তু সারা জীবন মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে আন্ডার গ্রাউন্ডে অদৃশ্য থেকে সংগঠন পরিচালনা করেছেন। এটি সর্বোত্তম পন্থা কিনা সেটি অন্য বিতর্ক। কিন্তু খ্যাতি ও জন স্বীকৃ্তরি মোহকে অস্বীকার করে, প্রচার মাধ্যমের আলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র জনসেবার ব্রতে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করা চাট্টিখানী ব্যাপার নয়। আত্মত্যাগের বাণী প্রচার সহজ, কিন্তু নিজের জীবনে তা অনুশীলনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ততোধিক কঠিন।
জীবনের এক পর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিপ্লবী রাজনীতির পাশাপাশি পরিবারপ্রতিপালনের জন্য গৃহ শিক্ষকতার কাজে নিজের কিছুটা সময় ব্যয়ে বাধ্য হয়েছিলেন নুরুল হাসান। আমার ছেলের গৃহ শিক্ষকও ছিলেন তিনি। পার্টির উপর নিজের আর্থিক নির্ভরশীলতার দায় যথাসম্ভব ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু যিনি সার্বক্ষণিক কর্মী, পার্টির উপর নির্ভর করা ছাড়া তার গত্যন্তরই বা কি? অন্যদিকে যিনি স্বেচ্ছায় অন্য পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে বিপ্লবের কাজে পূর্ণ মাত্রায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি তাকে জীবিকার জন্য জীবনের শেষ দিকে অন্য কোন পেশায় ফিরতে হয় তবে তার আগেকার সিদ্ধান্তটি কতটা বাস্তবোচিত ছিল? এই আত্মজিজ্ঞাসা কি তাকে পীড়িত করেছিল? বিপ্লব সংগঠনে সার্বক্ষণিক পেশাদার বিপ্লবীর প্রয়োজনীয়তা যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু তার শারীরিক ও সামাজিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিক তৎপরতার ব্যায়ভার কে বহন করবে? উপরন্তু দলে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে মতভিন্নতা ও উপদলের অস্তিত্ব বাস্তব। দলের ওপর মাসোহারা নির্ভর সার্বক্ষণিক কর্মী যিনি বা যারা দল নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অস্বীকার করে স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীন হতে পারবেন? বিপ্লবের পথে এ এক গুরুতর সমস্যা।
হাসান ভাই সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। পার্টি অফিসে তার মধ্যাহ্নের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় ছিল একটি কলা ও বন রুটি। উদার হৃদয় এই ব্যাক্তি তা থেকে আমাদের মত অসময়ে আগত অভ্যাগতদের ভাগ দিতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। ফার্মগেট থেকে অনেক সময় তিনি পার্টি অফিসে যাতায়াতের জন্য নিজের পদযুগল ব্যবহার করতেন। এ ব্যাপারে তার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তিনি আমাদের বোঝাতেন, বাসে গাদাগাদি ভিড়ের অস্বস্তি এবং পথিমধ্যে জ্যামের ব্যাপারটি হিসেব কষলে কষ্ট ও সময়ের প্রশ্নে তেমন ইতর বিশেষ হয়না। তিনি নিজের সুস্বাস্থ্য ও দৈহিক সক্ষমতাকে বক্তব্যের সমর্থনে স্বাক্ষ্য হিসেবে হাজির করতেন। তার দাবি ছিল এটি উত্তম ব্যায়াম। তার কথা হয়তো উড়িয়ে দেয়ার নয়। তবে আমার নিজের সন্দেহ হচ্ছে এক্ষেত্রে তার নিজস্ব বৈষয়িক বিবেচনারও ভূমিকা থেকে থাকতে পারে, যেটি তিনি উহ্য রাখতেন। তার সাথে অন্তরঙ্গতার কারণে আমি জানি, পারিবারিক অর্থনীতিতে ভাবির এবং পরবর্তী সময়ে তার বড় কন্যার অবদান তার চাইতে বেশি। বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে তিনি ভাবীর কাছ থেকে এই অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছিলেন যে বিবাহোত্তর জীবনে তার নিজের পথে চলার ক্ষেত্রে ভাবী বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। এই মহীয়সী নারী যতটা সম্ভব তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে বিয়ের আগে গৃহ শিক্ষকতার সুত্রে দুজনের জানা শোনা হয়েছিল।
হাসান ভাই কোন স্মৃতি কথা লিখে যাননি। যদিও অন্য অনেকের চাইতে তার স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ ছিল। তিনি বিপ্লবী সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। সিরাজ শিকদারের সাথে সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। অমল সেন, আব্দুল হক, শরদিন্দু দস্তিদার, আব্দুল মতিন ও আবুল বাশারের মত অগ্রজ বিপ্লবীদের কাছে থেকে দেখেছেন। ছাত্রজীবনে কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, বিমল বিশ্বাসদের সাথে ছাত্র ইউনিয়নে ও এর ধারাবাহিকতায় বামপন্থি আন্দোলনে একই সময়ে সক্রিয় ছিলেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের পিকিংপন্থি ধারার জোয়ার-ভাটা, ঐক্য-বিভক্তি- পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত প্রচারে অনাগ্রহের কারণে অন্যদের কাছে নিজের বিখ্যাত সহোদরের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিলেন, তাকে স্মৃতিকথা লিখতে উদ্বুদ্ধ করা কঠিন।
নুরুল হাসান আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করতে চান। জীবনে আর পার্টি ভাঙনের মত কাজে জড়িত হওয়ার পুনরাবৃত্তি চান না। ভুল-শুদ্ধের মধ্য দিয়ে সময়ের ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের পরিপুষ্টি ও অগ্রগতি হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় জীবনের একেবারে শেষ দিকে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এটি কি তার ব্যর্থতা? এটি কি কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই ট্র্যাজেডি নয়? তাঁর মতো পরীক্ষিত বিপ্লবী যে দল ত্যাগে বাধ্য হয় সে দলকে আমরা কিভাবে চিহ্নিত করবো?
কেউ কেউ হয়তো বলবেন নুরুল হাসান অন্য অনেক নেতাদের মতো তারকা খ্যাতির অধিকারী, বাগ্মী অথবা কমিটি আলোচনায় চৌকস ছিলেন না। অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও মুগ্ধ করার মতো যাদু ব্যক্তিত্ব তাঁর ছিল না। কিন্তু আমি জীবনে যে ক’টি সদা হাসিমুখ, দিলখোলা, মানুষের সন্ধান পেয়েছি তিনি তাদের অন্যতম। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অনেক নেতাদের নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশের পূর্বে কর্মীরা দ্বিধা ও সংকোচ বোধ করে এবং নিজের সমস্যা বিবৃত করার জন্য নেতার অনুগ্রহ ভাজন ‘মাধ্যম’ এর শরণ নেয়। কিন্তু নুরুল হাসান ছিলেন ব্যতিক্রম। তার কক্ষে প্রবেশের জন্য পূর্বানুমতি বা ‘ঢুকবো কি ঢুকবো না’ এই দ্বিতীয় চিন্তা মনে উদয় হতো না। তিনি ছিলেন ধপপপংংরনষব, সুগম্য। কর্মীদের সমস্যা শোনার মত ধৈর্য্য ও সময় তার ছিল। ব্যস্ততার ভান করে তাদের এড়িয়ে চলা তার স্বভাবে ছিল না। যদিও সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি অনেক ক্ষেত্রে তার হাতের নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু সদা হাসিমুখ, দিলখোলা, সদালাপী ও বন্ধুভাবাপন্ন, বিনয়ী এই মানুষটির আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। ফলে কর্মী নির্বিশেষে সকলের আস্থা ও প্রিয়ভাজন হতে তার সমস্যা দেখিনি। আমি জীবনে যে ক’টি সরল, উদার ও হৃদয়বান মানুষের সন্ধান পেয়েছি তিনি তাদের অন্যতম। এটি ছিল তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক- সাংগঠনিক প্রয়োজনে গণযোগাযোগের আয়াস সাধ্য কুশলতা নয়।
পার্টি জীবনে হাসান ভাই সর্বদা কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যত দিন তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে পার্টিতে বিকল্প সন্ধান বা বিতর্কের প্রয়োজন হয়নি। সততা এবং মিতব্যায়িতা এ দুই ব্যাপারেই তিনি ছিলেন দৃষ্টান্ত স্থানীয়। পার্টির এক পাই পয়সাও যাতে অপচয় না হয় এবং ব্যয় সংকুলানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। এ ব্যাপারে যে কারো বিরাগ ভাজন হতে পিছপা হতেন না। ফলে কি জমায়েত, জনসভা, নির্বাচনী ব্যয়, পার্টি কর্মীদের মাসোহারা, অফিসের ভাড়া, স্টেশনারি ও সরঞ্জাম ব্যয়ের যাবতীয় দায় ও হিসাবের দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপানো হতো। সমষ্টির কাজে বাজেট ঘাটতি না হলে উদবৃত্তের হিসাব বড় একটা কেউ খোঁজ রাখে না। কিন্তু তিনি প্রসন্ন চিত্তে সে হিসেব চুলচেরা দাখিল করতেন। একদা সততা, সচ্চরিত্র, নিষ্ঠা, ব্যক্তিজীবনে ত্যাগ স্বীকার ইত্যাদির জন্য কমিউনিস্টদের খ্যাতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। এটি ছিল ব্যাপক জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম উপাদান। নুরুল হাসান এই ধারার প্রতিনিধি, এই উত্তরাধিকার গর্বের সাথে তিনি আজীবন বহন করেছেন। দুঃখের বিষয় বর্তমান প্রজন্মের অনেক বামপন্থি নেতাদের মধ্যে এই আদর্শ উপেক্ষিত। জনসেবা নয় তারা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সাফল্য ও ক্ষমতা লাভে সচেষ্ট। দুর্নীতি ও জনগণের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অনুগতদের পোষণ ও পালন করলে সংগঠনের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা লাভে সমস্যা হয় না। কেননা অদীক্ষিত কর্মীদের এক বড় অংশের নিকট এটি অভিপ্রেত ও কাম্য গুণ। ‘জনতা ক্ষমতা ও শক্তির পূজারী’ নেতাদের এমত বিশ্বাস। শোষণ ও নিপীড়নমূলক প্রচলিত সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাও এই একই ধারণার ওপর টিকে আছে।
ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে কমরেড নুরুল হাসান সফল মানুষ ছিলেন এ দাবি করা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনে বহু ধরনের সীমাবদ্ধতা তাকে মেনে চলতে হয়েছে। তিনি সমষ্টিগত স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্বেচ্ছায় স্থান দিয়েছিলেন। ব্যক্তির একক সফলতায় আমাদের কীইবা আসে যায়? সমষ্টির অংশীদারত্ব যদি তাতে না থাকে বা দশের ক্ষেত্রে তার সুফল যদি হয় শূন্য? পক্ষান্তরে যিনি সমষ্টিগত স্বার্থে নিজের স্বার্থকে দলেছেন তিনি কী কিছুটা হলেও আমাদের কৃতজ্ঞতা দাবি করেন না
কেউ কেউ বলেন, নুরুল হাসানরা যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে কাজ করেছেন সে লক্ষ্য অলীক, অগম্য। ধর্মবিশ্বাসীদের মতোই অস্তিত্বহীন কল্পিত এক জগতের আরাধনায় তারা নিজের জীবনকে অপচয় করেছেন। নুরুল হাসানরা বিশ্বাসী, সে বিশ্বাস যুক্তিহীন। কিন্তু নুরুল হাসানদের তৎপরতার কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার, শুভবোধ ও সার্বজনীন মানব কল্যাণ প্রতিষ্ঠা। তারা দৃশ্যমান বাস্তবে অস্তিত্বশীল সমাজ সংঠনের পরিবর্তন যোগ্যতা এবং গণমানুষের সৃষ্টিশীলতা ও সক্ষমতায় আস্থাশীল। আদিম জীবন থেকে মানব প্রজাতির সভ্যতায় উত্তরণ ও মানব ইতিহাসের ক্রম অগ্রগতিতে মানুষের সৃষ্টিশীলতা প্রতিফলিত। কেউ কেউ ইতিহাসের এই আলোকদৃষ্টিকে উপলব্ধি করেন, নিজের মধ্যে ধারন করেন। ইতিহাসের গতি আঁকাবাঁকা। কখনো তা নতুনের অভ্যুদয়ের জন্য প্রতিকূল, প্রতিক্রিয়া তখন জেঁকে বসে। কিছু মানুষ এই নিস্ফলা সময়ে ও ভেঙে পড়েন না। তারা প্রগতির স্বপ্ন আঁকড়ে থাকেন। দলিত চাপা পড়া জন আকাঙ্ক্ষার উজ্জীবনে জল সিঞ্চন করে তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। ইতিহাসের কোন উর্বর মুহূর্তে তাদের স্বপ্নই জন চেতনায় রূপান্তরিত হয়ে পরিবর্তনকে সম্ভব করে তুলে। এ কারণে তাদের ব্যর্থতা ব্যক্তিগত সাফল্যকে ছাপিয়ে যায়। এরা স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্নের মৃত্যু হয় না। সমষ্টিগত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিজীবন মাপকাঠি নয়। সামাজিক প্রগতির মাপকাঠি মহাকাল, ইতিহাস। অনেকদিক থেকে অতি সাধারণ হলেও এই অর্থে নুরুল হাসান অসাধারণ। কারণ তিনি এক অসাধারণ স্বপ্ন নিজের মধ্যে লালন করেছেন। বৈরী সময়েও তাকে পরিত্যাগ করেন নি।
দেশে ফিরে যে ক’জন মানুষের সাথে দেখা করবো বলে স্থির করেছিলাম নুরুল হাসান তাদের অন্যতম। হায়, দেখা করার মতো মানুষ কতই না দুর্লভ। তদুপরি তারাও এক একে ঝরে পড়ছেন!
লেখক : সাবেক সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি
(লেখাটি সাপ্তাহিক একতা থেকে নেওয়া)