ডেস্ক রিপোর্ট

১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

নুর হোসেন তুমি কী দেখতে পাও?

আপডেট টাইম : নভেম্বর ১১, ২০২৩ ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক:

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ নুর হোসেন তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেদিন স্বৈরাচারী এরশাদকে উচ্ছেদের লড়াইয়ে বুকে পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এই শ্লোগান লিখে রাজ পথে নেমেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনকে বিলিয়ে দেন গণতন্ত্রের জন্য।

তাঁর এই আত্মবলিদানের ৩৬ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্র মুক্তি পায়নি। গণতন্ত্র সেদিন যেমন অধরা ছিলো আজও ২০২৩ সালে এসেও তেমনি অধরাই থেকে গেছে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বন্দি থাকে ব্যবস্থার মধ্যে, ব্যক্তি বা দলের কাছে না। ব্যক্তি বা দল শুধুমাত্র সেই ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে। এক শাসকের পরিবর্তে অন্য এক শাসক আসে কিন্তু শাসক বা শাসনের চরিত্র বদল হয়না। চরিত্র বদল তখনই হতে পারে যখন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব হয়।

অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশের ৫৩ বছর বয়সে গণতন্ত্র এখনও শিশু পর্যায়ে আছে, সাবালকত্ব অর্জন করেনি। কিন্তু আমি বলবো, এখানে গণতন্ত্র কখনো জন্মগ্রহনই করেনি। যে শিশু জন্মগ্রহণ করেনি তার শিশুকাল কী আর সাবালকত্ব কী!! দেশটিতে কখনো নির্বাচিত আর কখনো সামরিক স্বৈরাচার শাসন করেছে।

যে রাষ্ট্রের জন্মকালীন সময় থেকেই ব্যবস্থা স্বৈরাচারী সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ একটা আকাশ-কুসুম কল্পনা। ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে ডান-বাম অধিকাংশ দলের আন্দোলন-সংগ্রাম আবর্তিত হয়েছে ব্যক্তি ও দলের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন কখনওই এমনকি বর্তমানেও ব্যক্তি ও দলকে ছাপিয়ে বিদ্যমান লুটেরা ব্যবস্থা উচ্ছেদের লড়াইয়ে উর্ত্তীন হতে পারেনি। কারণ, আন্দোলনের লক্ষবস্তু থেকেছে বরাবর ব্যক্তি-দল অথবা জোট।

সেকারণেই শহীদ নুর হোসেনসহ তৎকালীন আন্দোলনে নিহত আরো অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের অর্জন এখনও শুন্যেই রয়ে গেছে। সেদিন যাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে সেই রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়েই আজ নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত করছে।

এটাই ট্রাজেডি হলেও এমনই ঘটবে সেটা আসলে নির্ধারিত ছিলো। এর চেয়েও নির্মম লুটেরা ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক দলের বাইরে যারা তথাকথিত জনগণের দল হিসাবে নিজেদের দাবি করে থাকেন ক্ষমতার অংশিদারিত্বের মোহে তারাও মিলেমিশে একাকার হয়ে যান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থানের যুক্তি তুলে ধরে।

কিন্তু এটা স্পষ্ট একটি বিষয় সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বিছিন্ন কোন ঘটনা নয়, এই স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই এর বীজ নিহিত। এর স্বরুপ উন্মোচিত হয়ে পড়ে যখন ললমনিরহাটের পাট গ্রামে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, যখন কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

যুগে যুগে শহীদ নুর হোসেনরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু তাদের এই আত্মবলিদান ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসাবে। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যে লক্ষ লক্ষ শহীদ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আজকের এই বাংলাদেশ দেখার জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেননি।
তাঁদের চেতনার বাংলাদেশের স্বরুপ তো এমন ছিলোনা। একই রকম ভাবে শহীদ নুর হোসেনও এমন বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেননি। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এমন একটি বাংলাদেশে বাস করছি যেখানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করলে পুলিশ গুলি করে তাদের হত্যা করছে; যেমন ৩৬ বছর আগে এই পুলিশই নুর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছিলো! কিছুই বদলাইনি আসলে!

যারা জীবন উৎসর্গ করেন তাঁরা রাজনীতিটা নির্ধারণ করেন না। রাজনীতির গতিমুখ কোথায় পৌঁছাবে এই সিন্ধান্তে তাদের যেমন অংশগ্রহণ থাকেনা একই রকম ভাবে যারা তৃণমূলে কাজ করেন তাদেরও থাকে না।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন উপরে বসে থাকা নেতৃত্ব। লড়াই সংগ্রামকে তারা ভুল গতি পথে পরিচালনা করেন। কেউ এটা জেনেশুনে করেন, কেউ সত্যিকারভাবে ভুল করেন। তবে সেই ভুল স্বীকার করলেও শিক্ষা গ্রহণ করেন না।

শহীদ নুর হোসেনরা জীবন দিয়েছেন যে লড়াইয়ে সেটি ছিলো ব্যক্তি স্বৈরাচার উচ্ছেদের। নুর হোসেনরা ভাবতেন, তাদেরকে ভাবানো হয়েছে এরশাদকে উচ্ছেদ করলেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর এই ভাবনা বা চেতনার মধ্যে বিন্দুমাত্র অসততা ছিলোনা।

নেতৃত্ব কিন্তু জানতেন ব্যবস্থা উচ্ছেদ ব্যতীত স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ হবেনা। তারা ক্ষমতায় যাবার অভিপ্রায়ে নুর হোসেনদের আত্মত্যাগকে ব্যবহার করেছেন। কারণ রাজনৈতিক দল হিসাবে তাদের শ্রেণি চরিত্র এই স্বৈরাচারি ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ না করে বরং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করণীয় তারা সেটিই করে। দেশের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এরা এমনই নির্লজ্জ চোখ-কান-নাক-মুখ বুজে নুর হোসেন দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করে। স্বৈরাচার বিরোধী শ্লোগান দেয়। স্বৈরাচারকে রুখে দেওয়ার অঙ্গিকার করে। নিজেরা নিজেদের দিকে তাকায় না! যদি তাকাতো তবে বুঝতো তাদের গা থেকে কি পরিমান দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। সেই দুর্গন্ধে শহীদ নুর হোসেনরা নাক চেপে ধরেও সহ্য করতে পারছে না!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, বর্তমানের এই ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় নুর হোসেনরা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। আমি বলবো, তাঁরা সবসময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক যতক্ষন না পর্যন্ত এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ না হচ্ছে।
কিন্তু তৎকালীন সময়ের মতো এক দলের পরিবর্তে অন্য দল, এক জোটের পরিবর্তে অন্য জোট, তবে সেদিন যেমন এই আত্মবলিদান যথাযথ মর্যাদা পায়নি, আগামী দিনেও তা পাবার সম্ভাবনা নেই।

যদি দল বা জোট উচ্ছেদের মধ্যে সংগ্রাম সীমাবদ্ধ থাকে তবে শহীদ নুর হোসেনদের স্বপ্ন অধরায় থেকে যাবে। শ্রেণি সংগ্রামকে ভিত্তি করে লড়াই-সংগ্রামকে ব্যবস্থা উচ্ছেদের সংগ্রামে উন্নিত করা ছাড়া বিকল্প অন্য কোন পথ নেই।
শহীদ নুর হোসেন দিবসের অঙ্গিকার হতে হবে, ব্যক্তি, দল বা জোট নয়, উচ্ছেদ করতে হবে বিদ্যমান লুটেরা ধনিক শ্রেণির সেবায় নিয়োজিত এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে। শহীদ নুর হোসেন আমাদের সংগ্রামের প্রেরণা!

”আমরা বন্দি থাকবোনা তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে, গ্রামে-দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়- তাতো তো তোমরা জানোই! কিন্তু তোমরা তো জানো না: কবে আমরা জ্বলে উঠব- সবাই- শেষবারের মতো!”

শেয়ার করুন