ডেস্ক রিপোর্ট

৩০ মার্চ ২০২৩, ২:৫০ অপরাহ্ণ

দৃশ্যমান সংকট আর অদৃশ্য সিন্ডিকেট

আপডেট টাইম : মার্চ ৩০, ২০২৩ ২:৫০ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যে দেশে যে কোনো অজুহাতে এবং সব অজুহাতেই পণ্যের দাম বাড়ানো যায়। সেটা খাদ্যপণ্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেলের দাম, পরিবহনের ভাড়া এমনকি হজযাত্রীর খরচ যে বিষয়ই হোক না কেন, আর রোজা, ঈদ, পূজা, পার্বণ, যুদ্ধ, মহামারী, বন্যা, খরা যে কোনো পরিস্থিতি আসুক না কেন। যেমন, করোনার অজুহাত শেষ হতে না হতে যুদ্ধের অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বেড়েই যাচ্ছে। যারা বলছেন সারা দুনিয়াতে বেড়েছে জিনিসের দাম, বাংলাদেশেও বাড়ছে তাদের উদ্দেশ্যকে সন্দেহ না করলেও তাদের যুক্তিকে যাচাই করা দরকার। যুদ্ধ হচ্ছে বলে তেলের দাম বাড়ছে, তেলের দাম বাড়ছে বলে উৎপাদন খরচ, পরিবহন খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে সব দ্রব্যের দামের ওপর। কিন্তু খরচ বেড়েছে কত এবং দাম বাড়ানো হয়েছে কত তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে কি? নাকি সামরিক যুদ্ধের অজুহাতে আরেক বাজারযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর?

রমজান মাস শুরু হয়েছে। রোজা রেখে সংযম করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু রমজান মাসেও ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ হয় না, জিনিসপত্রের দাম কমে না, খাদ্যে ভেজাল কমে না, ইফতার সামগ্রীতেও নানা ধরনের ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করা হয় বলে অভিযোগ আসছে হরহামেশাই। তাহলে সংযমের চর্চা কোথায়? অনেকে কৌতুক করে বলেন, কেন, জিনিসের দাম বাড়িয়ে সংযমের সহায়তা করা হচ্ছে সেটা কি বুঝতে পারছেন না?

কয়েকটা বিষয় নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে যে কেমন করে খরচ বাড়ে বা বাড়ানো হয়। হজকে অবশ্য পালনীয় কাজ হিসেবে গণ্য করে লাখ লাখ মুসলমান তাদের আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে হজব্রত পালন করতে যায়। কিন্তু আবেগের সঙ্গে অর্থনীতির সংযোগ প্রবল হয়ে উঠেছে। তাই হজের খরচ এবং হজ থেকে মুনাফা দুটোই বাড়ছে।

এ বছর সারা বিশে্বর মোট ১০ লাখ মানুষ হজ করবেন। বাংলাদেশে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। গত বছরে প্যাকেজ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। গত বছর কোরবানি ছাড়া প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৪৯ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছর হজের খরচ দেড় লাখ থেকে প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার পর্যন্ত বেড়েছে।

সব দেশেই হজের খরচ বেড়েছে, তবে বাংলাদেশে খরচ বৃদ্ধি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যেমন ইন্দোনেশিয়া থেকে একজন মুসলমানকে হজে যেতে হলে খরচ করতে হবে ৩ হাজার ৩০০ ডলার বা ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা। বাকিটা সরকারি ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ তহবিল থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে। মালয়েশিয়ায় যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম, সেসব পরিবারের সদস্যদের জন্য হজের খরচ ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। মাসিক আয় এর বেশি হলে দিতে হবে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। দেশটিতে হজের জন্য সরকার বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত পাকিস্তানে হজের খরচ ৩৬.৫৯ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ লাখ ৭০ হাজার পাকিস্তানি রুপি বা বাংলাদেশি টাকায় ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতে ২০২১ সালে খরচ ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় চার লাখ ২৩ হাজার ৫৭১ টাকা। তবে ভারত সরকার জানিয়েছে, হজ প্যাকেজের খরচ ৫০ হাজার টাকা কমানো হবে। অর্থাৎ সে দেশে হজ কমিটি অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে যারা যাবেন, তাদের খরচ হবে চার লাখ টাকার কম।

আবার রোজার মাসে যেসব পণ্যের ব্যবহার অস্বাভাবিক বেড়ে যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো খেজুর। এর যতটা ব্যবহারিক প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি হলো আবেগজনিত প্রয়োজন। তাই রমজানকে ঘিরে খেজুর আমদানি অনেক বেড়ে যায়। আমাদের দেশে আমদানি করা খেজুরের ৬০ শতাংশই আসে ইরাক থেকে। দ্বিতীয় স্থানে আছে আরব আমিরাত। মোট ২০ দেশ থেকে ২৮ ধরনের খেজুর আসে বাংলাদেশে। খেজুর আমদানি করা হয় সৌদি আরব, ইরান, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, ওমান, জর্ডান, মিসর, ফ্রান্স এবং ভারত থেকেও। আকার আকৃতি ও স্বাদের বিবেচনায় একেক দেশের খেজুরের দাম একেক রকম। একেক সময় একেক খেজুর বাজার দখল এবং মানুষের আগ্রহ তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে প্রচারের ভূমিকা কম নয়। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেজুর হলো ইরাকের ‘জাহেদি খেজুর’।

বাজার যাচাই করে দেখা গেছে যে, সাধারণভাবে খেজুরের চাহিদা থাকে গড়ে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টন। কিন্তু রমজান মাসে এর চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার টন। খেজুরের প্রধান উৎস যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য তাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খেজুর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে সরবরাহ করা হয় সারা দেশে। তুলনামূলকভাবে সামান্য কিছু খেজুর যেগুলো উন্নতমানের এবং দামি সেগুলো আমদানি হয় বিমানে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১২ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এবং সর্বশেষ আড়াই মাসে এসেছে আরও ১২ হাজার টন। আর পাইপলাইনে আছে আরও ১২ হাজার টন। এ তো গেল খেজুরের পরিমাণের ব্যাপার; দামটা নির্ধারিত হয় কোন পদ্ধতিতে সে বিষয়টা জানাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কয়েকটা তথ্য বিবেচনা করে দেখা যাক। চট্টগ্রামের একজন বড় আমদানিকারকের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আল্লাহর রহমত স্টোর’। রমজান উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় ২ হাজার ৫০২ টন খেজুর এনেছে। সেই হিসাবে প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ৭০ টাকা ৫৫ পয়সা। একইভাবে ‘কচমচ এন্টারপ্রাইজ’ ৬৬ টাকা কেজি দরে ২৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় ৩ হাজার ৬১০ ও ঢাকার গুলশানের বড় আমদানিকারক মদিনা গ্রুপ ১০০ টাকা দরে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় আমদানি করেছে ৬ হাজার ১৭৮ টন খেজুর। এর মধ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা ৮০ টাকা ১১ পয়সা দরে ৭৫ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ৯ হাজার ৪১৪ টন খেজুর এনেছেন। আমদানি নথি বিশ্লেষণ করলে গড়ে এমন দামের হিসাব পাওয়া যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ব্যাংক ঋণের সুদ, পরিবহন ব্যয়, মুনাফার মার্জিন। সব যুক্ত হলেও দাম কত হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর যেমন মিলবে না, তেমনি দেশের বাজারে কোথাও ২৫০ টাকা কেজির কমে খেজুরও মিলবে না। কোনো কোনো খেজুর আবার ১ হাজার ৮০০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, রমজানে দেশে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে পুঁজি করে আমদানিকারকরা দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি করেন। দেখা যাচ্ছে, তারা খেজুরভেদে কেজিতে ৩ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত মুনাফা করছেন। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, দেশে ২৮ ধরনের খেজুর আমদানি হলেও কাস্টমস শুল্কায়নের সময় ঘোষণা করা হয়েছে সব খেজুরের মান নিম্ন এবং দাম এক। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। শুল্কায়নের ক্ষেত্রে পার্থক্য না থাকলেও কিন্তু বন্দর থেকে খালাসের পরই পাল্টে যায় চিত্র। তখন খেজুর হয়ে যায় উন্নত, মাঝারি ও নিম্ন তিনটি ক্যাটাগরির। দামের বিশাল ব্যবধান তৈরি হয় বাজারে এবং বিপুল মুনাফা তুলে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক? ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের একটি আলোচনা সভায় উঠে এসেছে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা দরে। ফলে নিম্নবিত্তরা কেউ কেউ মুরগির বেশি দাম দেখে না কিনেই, অথবা মুরগির পা, গিলা, কলিজা, চামড়া কিনে বাড়ি ফিরছেন। নিম্নবিত্ত ক্রেতারা আস্ত মুরগি কিনতে পারছেন না বলে বিক্রেতারা পিস হিসেবে বিক্রি করছেন। বলা হচ্ছে, বাজারে মুরগির দাম নির্ধারিত হয় অদৃশ্য উৎস থেকে আসা এসএমএসের মাধ্যমে। বড় কয়েকজন উৎপাদক মিলে যে দাম স্থির করেন, অন্যরাও সে দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

দেশের কর্তাব্যক্তিরা স্বীকার না করলেও সক্রিয় আছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। সরকারের দায়িত্ব ছিল বাজারকে অসাধু তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখা, সে সরকার তা না করে সুবিধা করে দিচ্ছে গুটিকয়েক বৃহৎ ব্যবসায়ীদের। একদিকে তেলের দাম, পরিবহন খরচ বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে এ উৎপাদন খরচের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুর দায় চাপানো হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার-সংকটের ওপর। ভাবখানা এই যে, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, এটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই। তাহলে নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে চিনির দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পবিত্র রমজান মাসে দাম যাতে না বাড়ে সে জন্য সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়েছে এবং আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু মুনাফার কাছে পবিত্রতার মূল্য নেই। তাই শুল্ক কমেছে কিন্তু দাম কমেনি। চিনির শুল্ক কমার অর্থ রাজস্ব আয় কমে যাওয়া। রাজস্ব আয় দিয়েই তো সরকারের ব্যয় নির্বাহ হয়, জনগণের সেবায় বরাদ্দ হয়। তাহলে জনগণের তো দুদিক দিয়েই ক্ষতি। বেশি দাম দিয়ে পণ্য কেনা এবং সরকারি সহায়তা কমে যাওয়া। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েও জনগণ যে সুফল পাচ্ছে না, এর পেছনের কারণ বুঝতে পারা কি কঠিন?

যুদ্ধ কি পৃথিবীতে কম হয়েছে বা হচ্ছে? এমন কোনো দিন কি আছে, যেদিন পৃথিবীর কোনো দেশে বা কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ হচ্ছে না? এই যুদ্ধে বা শান্তিতে সব সময়ই তো সিন্ডিকেট সক্রিয় আর দুর্ভোগের বোঝা বয়ে চলছে সাধারণ জনগণ।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন