ডেস্ক রিপোর্ট
২৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:২২ অপরাহ্ণ
রাজেকুজ্জামান রতন:
দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম বিষয় হচ্ছে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া। এ নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থ পাচারকারী কারা, যদি সেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাহলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সহজ হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে, এরা এরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’ তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। কিছু টাকা পাচারকারীর নাম এসেছে পত্রপত্রিকায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদকের কিছু তৎপরতাও দেখেছে জনগণ। কিন্তু এ পর্যন্তই। পরবর্তী সময় এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আর কোনো শোনা যায়নি।
ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি। সবাই জানেন, এই গ্রুপের মালিকানায় বাংলাদেশে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একাধিক ব্যাংক আছে। এটা কোনো জাদুমন্ত্রে ঘটেনি। ইসলামী ব্যাংক থেকে তারা একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর আগে দুটি ভুয়া কোম্পানি খুলে, একই ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা নেওয়া হয় ঋণের নামে এবং আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ উঠে এবং কিছুক্ষণ পরে মিলিয়ে যায় তেমনি বাংলাদেশের দুর্নীতিসংক্রান্ত সংবাদের পুকুরে এসব খবর ঢেউ তুলে মিলিয়ে যায় বারবার। কিন্তু জনগণ হারায় তাদের সম্পদ আর আমানত। বিপরীতে সম্পদে ফুলে উঠে এসব প্রতিষ্ঠান।
বিশ^ব্যাপী টাকা পাচার নিয়ে কাজ করা যে সংস্থাটি বহুল পরিচিত সেটি হচ্ছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআই। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জিএফআই বাংলাদেশসহ ১৩৪টি দেশের অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেখানে অন্য সব দেশের হালনাগাদ তথ্য থাকলেও বাংলাদেশের তথ্য ছিল পুরনো, ছয় বছর আগের, অর্থাৎ ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যেও আবার সেখানে ২০১৪ সালের হিসাব ছিল না! ২০১৪ সাল বাদ দিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের যে তথ্য দিয়েছে জিএফআই, সেখান থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণের একটা গড় ধারণা পাওয়া যায়। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছিল। রিপোর্ট প্রকাশকালের বিনিময় হার হিসেবে ধরলে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) ওই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। আবার রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ২০১৫ সালের পর থেকেই জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। তথ্য নেই বলে কি দেশ থেকে টাকা পাচার থেমে আছে? এক বাক্যে উত্তর হবে, না।
এই খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, সুইস ব্যাংকগুলোতেও বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, আবার আকস্মিকভাবে কমছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছিল, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বেড়েছে।
সরকারের দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের অন্যতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার সত্যতা কিছুটা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের বড় উৎস হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ‘গ্র্যান্ড’ বা মহা দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, যেমন চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি ও দ্রুত অবলোপন, জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে কর্মরতদের বিদেশিদের অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন এবং বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়ে ও প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন লঙ্ঘন করে তা পাচার। আর অর্থ পাচারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের আধুনিক জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ। এসব দেশও আবার প্রলোভনের জাল বিছিয়ে রাখে। ফলে বিনিয়োগ ভিসা, স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাসের অনুমোদন, বিভিন্ন সেকেন্ড হোম প্রকল্প ও নমনীয় বিনিময় হারের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে।
এখানেই শেষ নয়, টাকা পাচারের পাশাপাশি চুরির ঘটনাও আছে। সম্প্রতি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে নির্মিত বলিউডের তথ্যচিত্র ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ মুক্তি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ চুরির ঘটনা সারা বিশে^ আলোড়ন ফেলেছিল। মনে করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধগুলোর একটি। ২০১৬ সালের সেই ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সাল পিকচার্স হোম এন্টারটেইনমেন্ট।
এক দল হ্যাকার কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের সামান্য একটি ভুল টাইপের কারণে আরও ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রক্ষা পায় বাস্তব এই গল্পই দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, ৫ কারণে টাকা পাচার হয়। এগুলো হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। ক্ষমতার ছায়া এবং ছোঁয়া পেলে তা যে আলাদিনের চেরাগের চেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়িয়ে দিতে পারে, তার নজির অনেক। তাদের এই সম্পদ তারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দেশে দেশে জমা করছেন। অর্থ পাচারের বড় কেন্দ্র দুবাই, এরপর সিঙ্গাপুর হলো নিরাপদ পাচার কেন্দ্র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ। শোষণমুক্ত দেশ গড়ার সেই আবেগের পেছনে প্রশ্ন ছিল কারা শোষণ করে? ফলে শত্রু যেমন ছিল তেমনি শত্রুকে চিনে নেওয়ার তাগিদ ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছে; তেমনি গান, কবিতা, নাটক, সিনেমার ভূমিকাও কম নয়। সেই সময় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রাজনৈতিক পোস্টারের ভূমিকা কম ছিল না। যে ঐতিহাসিক পোস্টার ’৭০-এর নির্বাচনে জনমতকে প্রভাবিত করেছিল তা হলো সোনার বাংলা শ্মশান কেন? সেদিনের বৈষম্য ও লুণ্ঠনের চিত্র এমনভাবে ফুটে উঠেছিল সেই সাদামাটা পোস্টারের লেখায়। এই পোস্টার কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়নি। আজ স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রশ্ন তুলতে হবে বৈষম্য এত তীব্র কেন? পুঁজিবাদী শোষণ, দুর্নীতি, টাকা পাচার মিলে সোনার বাংলাকে ফাঁকা এবং ফাঁপা করে ফেলেছে যে শাসক গোষ্ঠী, তাদের চিহ্নিত করাই শুধু নয়, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলাটাও জরুরি।
লেখক: বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক ও কলামিস্ট