ডেস্ক রিপোর্ট

৬ আগস্ট ২০২৩, ৩:৫৭ অপরাহ্ণ

ছোট ছোট মানুষের ছোট কিছু আশা

আপডেট টাইম : আগস্ট ৬, ২০২৩ ৩:৫৭ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

সারাদেশ এখন সমাবেশ, মিছিল আর রাজনৈতিক বিতর্কে সরগরম। সবাই বলছেন, দেশ বাঁচাতে দরকার তাদেরই। যদিও এই প্রশ্ন খুব কম সংখ্যক মানুষই করছেন যে, স্বাধীনতার পর তো ৫২ বছর পেরিয়ে গেল। ক্ষমতায় আপনারাই ছিলেন, তাহলে দেশ এখনো আধমরা কেন? আর একে বাঁচানোর জন্য এত উৎকণ্ঠা ফুটে উঠছে কেন আপনাদের গলায়? ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা জোরের সঙ্গে বলছেন আরও দীর্ঘদিন থাকলে কী কী লাভ হবে দেশবাসীর এবং এ যাবৎ কী কী অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। সেসব শুনছেন দেশের মানুষ। অন্যদিকে এই সরকার ক্ষমতায় থেকে জনগণের কী কী ক্ষতি হয়েছে, তার বিবরণও মানুষ শুনছে। এসব কথা শোনানোর জন্য সমাবেশ, মিছিল হচ্ছে দেশের বড়-ছোট শহরগুলোতে। সমাবেশে নেতারা বলছেন, কর্মীরা শুনছে, নেতাদের শোনা কথা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে চায়ের দোকানে, আড্ডায় এবং আড্ডা পরিণত হচ্ছে কখনো সহিংসতায়। উন্নয়নের মোহময় বর্ণনা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ হয়তো নিজেদের দিকে চোরা চাউনি দিয়ে তাকিয়ে দেখেন, যাচাই করে দেখেন আসলে উন্নয়ন যত হয়েছে বলে বক্তৃতায় বলা হচ্ছে, তার প্রতিফলন জীবনে ঘটেছে কিনা? আবার যারা বিরোধিতা করছেন তারা বলছেন, উন্নয়ন হয়েছে যত, দুর্নীতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি। শ্রোতারা এ কথা শুনেও চারপাশে তাকিয়ে দেখছে, দেখি তো উন্নয়নের সুফল কার কার ঘরে গেল?

বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার শান্তিপূর্ণ এবং সমঝোতার পথ হলো নির্বাচন। যদিও নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, তারপরও যারা গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব এসব কথায় ভুরু কুঁচকে ফেলেন, তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ শান্তিপূর্ণ বলে গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো দলের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে তারা কত ভোট পায়, সেটাকেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই নির্বাচন টাকার খেলায় পরিণত হওয়া, সংসদ ব্যবসায়ীদের ক্লাব বলে আখ্যায়িত হওয়া, নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভূলুণ্ঠিত হওয়া, ভীষণ আবেগে উচ্চারিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পদদলিত হওয়া আর নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষ আচরণ না পাওয়ায় এখন শুধু ‘নির্বাচন চাই’ বললেই চলে না। এখন দাবি করতে হয়, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি ইতিমধ্যে এতটাই জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন দল পর্যন্ত বলছে, আপনারা নির্বাচনে আসুন, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেব। বিদেশিদের সাক্ষী রেখেও বলা হচ্ছে এসব কথা।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো নির্বাচনে উৎসাহী জনগণের দেশে, এ যাবৎকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ইতিহাস সুখকর নয়। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪টি নির্বাচনকে আপাত গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। এই চারটি নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্দোলনের পটভূমিতে এবং নির্বাচনকালীন সরকার ছিলেন দল নিরপেক্ষ। বিশেষ করে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই আশঙ্কা তো স্থায়ী হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। পরবর্তী সময় উপনির্বাচনগুলো এবং সাম্প্রতিক উপনির্বাচন এই আশঙ্কাকে আরও দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন বলছে, আমাদের অধীনেই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন হতেই হবে তখন তীব্র রূপে তার বিরোধিতা হচ্ছে এবং এই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। ফলে দেশ বিভাজিত নির্বাচন প্রশ্নে। সমাবেশ, শক্তি প্রদর্শন সবই চলছে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। সমাবেশগুলো এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

এসব বড় বড় সমাবেশের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ছোট ছোট মানুষের বিশাল বেদনা। দেশের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার)ভুক্ত কলেজের সংখ্যা ৪ হাজার। প্রায় ২০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল, ৯ হাজার মাদ্রাসা এবং ৬ হাজার কারিগরি প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানই কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধরে রেখেছে, গড়ে তুলেছে। প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক যারা দেশের ৮৫ ভাগের বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করেন, তারা এমপিওভুক্ত। এই শিক্ষকরা বাড়ি ভাড়া পান মাসে মাত্র ১ হাজার টাকা, অবসরকালীন ভাতা বলে কিছু নেই। তারা তাদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে এসেছিলেন ঢাকায়। দাবি জানানোর আর কোনো পথ না পেয়ে দিনের পর দিন প্রেসক্লাবের সামনে বসে থাকলেন, পুলিশের লাঠিপেটা খেলেন। মার খেয়ে শিক্ষকরা বেদনা আর অপমানে নীল হয়েছেন। বলেছেন, আমরা শিক্ষক, এই কী আমাদের প্রাপ্য? আমাদের কাছে আধুনিক মানুষ গড়ার শিক্ষা চান, কিন্তু আধপেটা খাওয়া আর লাঠিপেটার শিকার হওয়া শিক্ষক দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কত উন্নতি হবে? বড় বড় সমাবেশে এই শিক্ষকদের জমাটবাঁধা কষ্টের কথা গুরুত্ব পেয়েছে কি?

সরকারি হিসাবেই দেশের শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ। এই শ্রমশক্তির ৮৮ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে তাদের হাত চললে ভাত জোটে বা দিন আনি দিন খাই অবস্থা। দেশের বড় রাজনৈতিক দলের বড় সমাবেশে এরাই প্রধান অংশগ্রহণকারী। দেশের এত উন্নয়নে তাদের জীবনে কতখানি উন্নতি ঘটল সেটা চোখে পড়ছে না। যদিও দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলেছেন, এসব শ্রমজীবীরা নাকি এখন খুবই ভালো আছেন। তারা যে মজুরি পান তাতে নাকি দিনে ২০ কেজি চাল কিনতে পারেন। শুধু চাল খেয়ে মানুষের জীবন বাঁচে না। আবার বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, যাতায়াত, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বিপদের সঞ্চয়ের কথা ভাবার দরকার আছে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। তবে দিনে ১২০০ আর মাসে ৩৬ হাজার টাকা রোজগারের পথ থাকলে ২০ হাজার টাকায় অফিসের পিয়ন, গাড়িচালক, ৮ হাজার টাকা মজুরি আর ওভারটাইমসহ ১২ হাজার টাকায় গার্মেন্টসে কাজ করার লোক যে পাওয়া যেত না তা নিশ্চিত। বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য মজুরি বোর্ড আছে। ৪৩টি সেক্টরের জন্য মজুরি বোর্ড থাকলেও বাকিদের জন্য নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর মজুরি নির্ধারণের বিধান আছে। পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্য বা জীবনযাপন ব্যয় কত বাড়ে আর মজুরি কত বৃদ্ধি পায় তার তুলনা করলে দেখা যায়, শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি দিন দিন কমছে। অথচ এই শ্রমজীবীরাই তো উৎপাদনের চালিকাশক্তি। তাদের কথা কি উঠে আসছে কিংবা তাদের জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেখা যাচ্ছে?

কৃষক উৎপাদন করে, মাঠে ফসল দেখে সে হাসে আর বিক্রি করে সে কাঁদে। বাজারে মৌসুমেও চালের দাম কমে না, সবজির দাম তেমন কমে না, এটা ভুক্তভোগীরা জানেন। কিন্তু কৃষক যে ন্যায্য দাম পায় না সে মর্মবেদনা শুধু কৃষকরাই ভোগ করে থাকেন। কৃষি বাজেট বাড়ে না কেন, কৃষি উপকরণের মূল্য সহায়তা কৃষক কতটুকু পান, কৃষি উৎপাদন করে কেন কৃষক অসহায় হয়ে পড়েন ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে? এসব প্রশ্নের উত্তর এবং এই দুরবস্থার দায় নেওয়ার কথা কি সমাবেশগুলোতে উচ্চারিত হচ্ছে? দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় কৃষিতে, খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করে কৃষি, সেই কৃষকরা সমাবেশে হাজির হন, উজাড় করে ভোট দেন, কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা কি পায়?

মধ্যবিত্তের করুণ দশা নিয়ে কথা বলার কিছু আছে? সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯.৩ শতাংশ, বাস্তবে যা ২০ শতাংশের বেশি। কারণ সাধারণ মানুষ যা ভোগ করে যেমন চাল, আটা, ডাল, চিনি, তেল, লবণ, সবজি, পেঁয়াজ, মরিচ, মাছ, ডিম, মুরগি কোন জিনিসের দাম বাড়েনি? সব কিছুর দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বাজার সিন্ডিকেটের একটা দারুণ সমন্বয়। একবার পেঁয়াজ, আর একবার মরিচ, কখনো ডিম তো কখনো মুরগি! এক মাসে তেলের দাম বাড়ে তো অন্য মাসে চিনিÑ এমনি করে চক্রাকারে চক্রশুলে বিদ্ধ করছে ভোক্তাদের। যেমন মৌসুমে পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলল তারপর আবার ৬০ টাকায় নেমে এলো। এ সময়কালে পেঁয়াজের কোনো নতুন উৎপাদন কি হয়েছে? তাহলে দাম কমল কেন? আসলে এ সময়ে উৎপাদন হয়েছে ব্যবসায়ীর মুনাফার আর জনগণের দুর্দশার। এই সিন্ডিকেটের কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর কথা কি শোনা যায় সমাবেশের ঘোষণায়?

তবে কিছু মিছিল হয়, সমাবেশ হয় দ্রব্যমূল্য কমানো, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম, শিক্ষা-চিকিৎসায় রাষ্ট্রের বরাদ্দ বাড়ানো, রাষ্ট্র যেন জনগণকে দমন না করে আর দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় না দেয়, নির্বাচনে টাকার খেলা, পেশিশক্তি, প্রশাসন আর পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ করা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার দাবিতে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো এসব সমাবেশ গুরুত্ব পায় না। যেমন অর্থনীতিতে পুঁজির দাপটের কাছে পরাস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, তেমনি রাজনীতিতেও চাপা পড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের দাবি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ে, বাজারেও বাড়ে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ। পুড়ছে মানুষ কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে না। এসব ছোট ও দুর্বল মানুষের ছোটখাটো কষ্ট দূর করার জন্য রাজনীতিতে একটা বৃহৎ মোড় ফেরানো দরকার। তা না হলে তারা শুধু সমাবেশের শক্তি বাড়াবেন, আর নিজেরা ক্রমাগত শক্তি হারাতে থাকবেন। এ থেকে বাঁচার কোনো সহজ পথ নেই। তাই সংকট নিরসন ও সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন-সমাবেশের সঙ্গে ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন যুক্ত করার জরুরি কাজটা করতেই হবে।

লেখক: বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন