ডেস্ক রিপোর্ট
১১ আগস্ট ২০২৪, ২:৩৯ অপরাহ্ণ
রাজেকুজ্জামান রতন :
বৈষম্যের অবসান ও সংস্কারের আকাক্সক্ষা নিয়ে দেশের মানুষ লড়ছে বহু দিন ধরে। এই লড়াইয়ে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে অনেকবার। কিন্তু বিজয় হাতছাড়া হয়েছে বারবার। তারপরও বঞ্চনা আর অপমানের প্রতিকার চেয়ে মানুষ লড়ে যায় বারবার। রচনা করেছে ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৯০। কিছুটা পার্থক্য সত্ত্বেও এবারের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান অতীতের সেই স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিয়েছে আবার। সাধারণভাবে দেখলে এটা স্পষ্ট যে, পনেরো বছরের দুঃশাসকের অবসান ঘটেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়েছে সারা দেশ। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। মানুষ গান গেয়েছে, নেচেছে, ভুলে গিয়েছে এতদিনের বেদনা, কষ্ট আর অপমান। সব ছাপিয়ে সবার কণ্ঠে একই কথা অনেক বেদনা সয়ে এবার মনে হয় গণতন্ত্র পাবো।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে কিংবা শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর প্রতিশোধের পালা শুরু হবে এটা জানত সবাই। আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ বলেছেনও এ কথা। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করেননি বরং নিপীড়ন চালিয়েছেন আরও বেশি। প্রদীপ নেভার আগে জ্বলে ওঠার মতো ক্ষমতার শেষ কয়েক দিন তাদের কথা এবং কাজ ছিল চরম ফ্যাসিস্টদের মতো। আন্দোলনকারী এবং প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার হিংস্রতা নিয়ে নিজেরা নেমেছিল, পুলিশকে নামিয়েছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, ভেবেছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যেভাবে দমন করেছিল এবারও তারা সফল হবে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলেও আন্দোলনকারীরা পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। মৃত্যুকে জয় করার সাহস অর্জন করেছিল। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ছিল মিথ্যার এবং অপপ্রচারের। ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে পুলিশ আর প্রশাসন দিয়ে, মেরে এবং মামলায় জড়িয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল বিরোধীদের। শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে আদালতকে। ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি করতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে প্রশাসন, পুলিশ এমনকি বিচার বিভাগকেও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দলীয়করণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আমলাদের সম্পদের পাহাড় দেখে বিস্মিত হয়েছে দেশবাসী। জবাবদিহি ছিল না ব্যবসাবাণিজ্য কোনোখানেই। সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচার হয়েছে তা অকল্পনীয়। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জনজীবন বিপর্যস্ত আর চাঁদাবাজিতে ছিল অতিষ্ঠ। আকস্মিক সম্পদের মালিক হয়েছে অনেকেই, যাদের পরিচয় তারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগ্রহপুষ্ট। এসব দেখে মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে মানুষ। হামলা করেছে থানায়, গুলিতে মরেছে এবং মেরেছে পিটিয়ে। আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়েছে অনেক থানা। আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মানুষ মরে। এবারও মরেছে শত শত। শত শত লিখলাম কারণ সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। এটা পাঁচশ হতে পারে, হাজার ছাড়িয়ে যেতেও পারে। গুলি করেছিল পুলিশ, ব্যবহার করেছিল সব ধরনের অস্ত্র। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলেছিল, গুলি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমরা শেষ হবো না। পরাজিত হয়েছে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে জীবন দিয়েছে শত পুলিশ। গুলিতে মরেছে ছাত্র-জনতা, পিটিয়ে মেরেছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের।
প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতা-কর্মীদের অনেকেরই বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আগুনে পুড়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান, পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে অনেকে। গুলি চালিয়েও মানুষকে ঠেকাতে পারেনি। পুঞ্জীভূত ক্রোধের ক্ষমতা এতই প্রচণ্ড। এত দিনের দম্ভ, অহংকার, মানুষকে অপমান করার পরিণতিতে বাঁচার আকুতি নিয়ে মরতে হয়েছে বা বাঁচতে গিয়ে পালাতে হয়েছে তাদের। ইতিমধ্যে ধ্বংস করা, গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক সরকারি স্থাপনা। বিক্ষুব্ধদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না, কেউ নিয়ন্ত্রণ করতেও যায়নি। ক্রোধে যেন উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল একদল মানুষ। সে সময় যুক্তির কথা, মানবিকতা সব যেন পরাস্ত হয়ে গিয়েছিল। পনেরো বছরের দুর্নীতি, দুঃশাসন আর দমনপীড়নের জ্বালায় মানুষ যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিল যে, এসব জনগণের সম্পত্তি। কারণ ক্ষমতাসীনরা এসব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানে উদঘাটিত হয়েছে অনেক দিনের ধারণা করা আয়না ঘরের অস্তিত্ব। প্রচারিত ছিল যে, গুম করে রাখা মানুষদের বছরের পর বছর আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ‘আয়না ঘর’ নামে পরিচিত নির্যাতন কেন্দ্রে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্রমাগত অস্বীকার করা হয়েছে। কাউকে গুম করা হয়নি, এ কথা জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পরপরই আয়না ঘর থেকে বন্দিদের মুক্তি যেমন বিস্ময় জাগায় তেমনি প্রশ্ন তৈরি করে, এভাবে একটি বাহিনীর নামে নির্যাতন করা কি অপরাধ নয়? এটা কোন আইনে করা হয়েছে?
কিন্তু কেন এমন হলো? ২০০৮ সালে তো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তারপর গদি ধরে রাখার জন্য ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর যে তিনটি নির্বাচন তিনি করেছিলেন সেগুলো না ছিল সুষ্ঠু, না ছিল গ্রহণযোগ্য। মানুষ ভোট দিল কী না দিল, কোনো পরোয়াই তিনি করেননি। পুলিশ, প্রশাসন ব্যবহার করে তিনি ক্ষমতাকে এতটাই সংহত করেছিলেন যে, কোনো প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করে লাভ হয়নি। নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর এবং প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ ভাবার যে মানসিকতা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সংক্রামিত হয়েছিল। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ এবং আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার একটা গোপন বাসনা চরিতার্থ করতে সমালোচনার কণ্ঠকে চেপে ধরতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিশেষ করে অনলাইন নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ প্রয়োগ করেছে। নাগরিক অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে মারাত্মকভাবে। নাগরিক সমাজ অপমাণিত হয়েছে পদে পদে। জনগণ একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নজির দেখেছে আর অন্যদিকে গরিব ও ধনীর বৈষম্য বেড়েছে। ব্যাংক কেলেঙ্কারি বেড়েছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। প্রচ- অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতি মিলিত হয়ে জনগণের অসন্তোষকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
সাম্প্রতিক যে ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করল, তার শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের একটি সাধারণ দাবি থেকে। স্ফুলিঙ্গও যে দাবানল তৈরি করে তার একটি হুঁশিয়ারিমূলক দৃষ্টান্ত এটা। এই ভূখণ্ডে গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছে কয়েকবার কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্য এক পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে যে উন্নয়নের নামে বৈষম্য, দুর্নীতি, দমনপীড়ন আর অপমান মানুষকে কতটা ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। এই ভূখন্ডের ইতিহাসে এত বেশি পুলিশের ওপর আক্রমণ আগে কখনো হয়নি। ব্রিটিশ আমলে অত্যাচারী পুলিশকে গুপ্ত হত্যা করা হয়েছে সেটা হাতে গোনা কয়েকজন এবং তারা সবাই ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা। কিন্তু এবার থানা পুড়িয়েছে এমন কি পুলিশের সদর দপ্তরেও হামলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ কেন তাদের সদর দপ্তরকে রক্ষা করতে পারেনি? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে, পুলিশের একটা বড় অংশ কি একই কারণে একই পথ অনুসরণ করেছে?
গত ১৫ বছরের দুটি বড় বিষয় এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন। একটি হচ্ছে দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রধান শর্ত; আর অন্যটি হচ্ছে দুর্নীতির বিনিময়ে চাকরি দেওয়া। দ্বিতীয় শর্ত প্রথম শর্তকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়ায় দুর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে পড়েছিল। গ্রেপ্তার বাণিজ্য, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, রিমান্ডে নেওয়ার নামে টাকা আদায়, অপরাধীদের সঙ্গে সমঝোতা এমনকি মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে টাকা রোজগার করার কথা তো ছিল ওপেনসিক্রেট। আর দলীয় আনুগত্যের কারণেই সরকারবিরোধীদের দমনে পুলিশ বেপরোয়া আচরণ করেছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ যতই নিষ্ঠুর হয়েছে, ততই তাদের প্রতি বিক্ষোভকারীদের আক্রোশ এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে এই বিপর্যয়ের জন্য পুলিশ বাহিনীর পরিচালনাকারীরাই দায়ী। রাজনৈতিক দল এবং পুলিশের বড় কর্তারা পুলিশ বাহিনীকে ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতক বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। যার বিষময় ফল ভোগ করতে হয়েছে সবাইকে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এখন ভীষণরকম প্রতিশোধমূলক আক্রোশের শিকার হচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই চরম নিষ্ঠুরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের যে নিগৃহীত করেছেন তাও যেমন নিন্দনীয়, তেমনি নিন্দনীয় প্রতিশোধের নামে হত্যা ও লুটপাট। সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এখন তাহলে কী করণীয়? শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা যেন মানুষের মনে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে সেই লক্ষ্যে প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ সর্বত্র জবাবদিহির আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে দলীয় আনুগত্যমুক্ত করা, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং অর্থনৈতিক অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগগুলোর বিচারের প্রশ্নগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা এবং সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার যে আকাক্সক্ষা তা পূরণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইতিহাস বলে, যেকোনো গণঅভ্যুত্থানে এ ধরনের উন্মত্ততা, প্রতিশোধ পরায়ণতার প্রকাশ ঘটে থাকে। কিন্তু প্রতিশোধ কোনো সমাধান নয়, এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার বদল করতে হবে। দরকার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে বদল। দখলদারিত্ব, চেহারার পরিবর্তন হলো, কিন্তু চরিত্রের যদি বদল না হয় তাহলে এত রক্তদান বৃথা হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, নারী, ধর্ম ও জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে। শ্রমিক কৃষক ছাত্র আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হয় বৈষম্যের নির্মম শিকার। সংস্কারের আকুতি যেন সুবিধার প্রলোভনে পরাস্ত না হয়, এটাই সাধারণ মানুষের অতি ন্যূনতম চাওয়া।
লেখক: সহকারি সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ও কলাম লেখক