ডেস্ক রিপোর্ট

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১:২১ পূর্বাহ্ণ

একজন হিরো আলম : আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতা

আপডেট টাইম : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ ১:২১ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

আবু নাসের অনীক:: আমরা একটা ঘোরতর অবক্ষয়মূলক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আছি। হিরো আলম এর রাজনৈতিক কর্মকান্ড তারই অন্তর্ভূক্ত একটা বিষয়। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলোনা আদৌও। আজকে তার মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগে যোগদান বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা হতে দেখেই আমার আজকের এই নিবন্ধ লেখা।

অনেকেই হতবাক হচ্ছেন; আবার কেউ কেউ এর নানা ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। কিন্তু আদৌও এগুলোর সাথে তার কর্মকান্ডের সামঞ্জস্যতা আছে কিনা সেটা নিয়ে বিবেচনা করছেন না।

একটি পক্ষ তাদের অক্ষমতা আর অপারগতার জায়গা থেকেই তাকে মজলুম বানিয়ে ছেড়েছেন। এই বিষয়ে তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই নেই বল্লেই চলে। কাউকে মজলুম হিসাবে অভিহিত করলেই শুধুমাত্র হয়না। এর সাথে তার অবস্থানের জাস্টিফিকেশন থাকতে হয়।

কেন সে মজলুম? সরল দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে দেখা হয়েছে সে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে এসেছে। এটিই মজলুম হওয়ার জন্য তার একমাত্র মাপকাঠি। প্রতিদিনই প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা হাজার হাজার মানুষ এই সমাজে-রাষ্ট্রে নির্যাতিত হয়ে আসছে। কিন্তু তাদের কথা এই ব্যক্তিরা কেউ উচ্চারণ করেন না। কারণ হিরো আলমকে কভারেজ দেওয়ার জন্য মিডিয়াগুলি ওতপেতে থাকলেও তাদের জন্য থাকে না।

সমাজে যার বিন্দুমাত্র সামাজিক অবদান নেই এমন একজন মানুষকে নিয়ে মিডিয়া সরগরম করে। কারণ এতে বাণিজ্য হয়। ব্যবসা হয়। হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। সমাজের সমস্ত মানুষের চিন্তাকে অন্যদিকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। এবার আসি একটু একাডেমিক আলোচনায়।

মার্কস ও এঙ্গেলস ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’ নামে একটি শ্রেণির কথা বলেছেন। দূর্বলের ওপর বলপ্রয়োগ যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা এমন পরিবেশে এই দরিদ্র শ্রেণি বাস করে। একটি বিভৎস পরিবেশে বাস করার জন্য এই মানুষদের মনে নৈতিকবোধ তৈরি হয়না। কেবল মাত্র নিজ চাহিদা মেটানোর প্রতিই তাদের সকল মনযোগ কেন্দ্রিভূত থাকে।

কমিউনিস্ট পার্টি ম্যানিফেস্টো-তে এই শ্রেণিকে উল্লেখ করা হয়েছে বিপজ্জনক শ্রেণি এবং সমাজের আবর্জনা হিসেবে। দ্য পেজেন্ট ওয়ার ইন জার্মানি গ্রন্থে অ্যাঙ্গেলস সতর্ক করেছেন যে, ‘এই অর্থলোলুপ এবং নির্লজ্জ শ্রেণির মানুষদের ওপর কোনো বিপ্লবী কর্মকান্ড- পরিচালনা করার জন্য কখনোই নির্ভর করা যাবে না।’

আমাদের মনে হয়না, এই ব্যক্তিটিই টাকার জন্য খুনের দায়ে অভিযুক্ত দেশ থেকে পলানো একজন আসামীর জুয়েলারির দোকান উদ্বোধনে দুবাই গিয়েছিলো। লোকটির অতীত সম্পর্কে আমরা বিস্মৃত হয়ে গেছি; শুধুই আমাদের নিজেদের হতাশাকে আড়াল করার জন্য। লোকটি এপর্যন্ত যা করেছে সবই তার ব্যক্তি স্বার্থকে কেন্দ্র করে। আর আমাদের যেহেতু কিছুই করার নেই আমরা আছি তাকে মজলুম এর প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
তাহলে কেন এমনটি ঘটছে? কেন আমরা এই বিষয়টিকে নিয়ে এতো বড় করে দেখছি? নব্বই পরবর্তীতে এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি ভূমিধস তৈরি হয়, এরা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

রাজনীতিটা পুরোপুরি চলে যায় লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাতে। ১৯৯১ সালে ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫৮ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৫৭ শতাংশ; ২০১৪ সালে ৫৯ শতাংশ এবং বর্তমান সংসদে ৬১ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশের তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আসলে বিলোপ ঘটেছে। যাদের এখন মধ্যবিত্ত হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তারা প্রকৃতপক্ষে লুটেরা ধনীক শ্রেণির লেজুড় অংশ। যাদের প্রতিবাদের কোন ভাষা নেই। না সাহিত্যে না রাজপথে।
এরা সমাজের সকল পর্যায়ের অনাচারের সাথে হয় আপোস করছে নতুবা তাদের সুবিধাভোগী হিসাবে নিশ্চুপ থাকছে। দূর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রভাবে তারাও কোন কোন ক্ষেত্রে লুটেরার সহযোগি হিসাবে ভূমিকা রাখছে।

অবশিষ্টাংশ যেটুকু আছে তার একাংশ মুখ বন্ধ করে পড়ে আছে। মনে করছে কোন এক দেবদূত এসে তাদেরকে এই সংকট থেকে মুক্তি দিবে। আর একটি অংশ নিজেদেরকে একটা সুখী-সুখী ইমেজের মধ্যে নিয়ে গেছে। এই হচ্ছে আমাদের এখনকার মধ্যবিত্ত।

এই শ্রেণির আজকের এমন নৈতিক স্খলনের পেছনে লুটেরা রাজনীতির দায়টাই প্রধান কিন্তু সেটাই একমাত্র নয়। বাম-প্রগতিশীলদের দায়টাও কোন অংশে কম নয়। আদর্শভিত্তিক বামধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চর্চা নব্বই পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে দূর্বল হয়ে যায়।

যে নেতৃত্ব বা সংগঠন একসময় মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারতো তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তারা তাদের নিজেদের যাপিত জীবনেই সেই মূ্ল্যবোধ ধরে রাখতে পারেননি। ফলে সমাজে তাদের যারা অনুকরণ করে বেড়ে উঠতো তারা আজ আকন্ঠ হতাশায় নিমজ্জ্বিত।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই অংশের হতাশা, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষোভ, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানাতে যেয়ে ভুল বিষয়কে নির্ধারণ করছে তার সংগ্রামের প্রেরণার অংশ হিসাবে। আমাদের সেই মধ্যবিত্ত অংশই আজকে হিরো আলমেকে নিয়ে মেতে আছে মজলুম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য!

আজকের বাংলাদেশে হাজার হাজার পাটকল শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়ে ফেলেছে। লাখ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক প্রতিনিয়তো নির্যাতনের স্বাীকার হচ্ছে, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে; তখন তাদেরকে মজলুম হিসাবে কেউ ঘোষণা করছে না বা তাদের পাশে দাড়াঁচ্ছে না। কারণ মিডিয়া তাকে তুলে ধরছেনা।

কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমগুলিকে গণমাধ্যমের লেবাস পরিয়ে রেখেছে। যাতে একদিকে প্রচার অন্যদিকে দর কষাকষিতেও সুবিধা করা যায়। এই প্রচার মাধ্যমগুলিই সমাজে সামাজিক সম্মতি উৎপাদন করে।

কোনটির পর কোনটি প্রচারে এনে পরিস্থিতি কোন দিকে নিতে হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। লুটেরা এ সমস্ত কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর যে অংশ সহায়তা করতে প্রস্তুত তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এ কারণেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে আসবে না আসবে সেটা নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। তাদের মালিকানাধীন তথাকথিত গণমাধ্যম ব্যবহার করে তার পক্ষে জন সম্মতি গড়ে তোলে।

ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইয়ে চমস্কি এবং হারম্যান বলেন,‘গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচারণা চালিয়ে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করে তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের গণস্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের পক্ষে সম্মতি আদায় করে নেওয়া’। এক্ষেত্রে তাঁরা বলেছেন যেকোন সংবাদকে ধাপে ধাপে পাঁচটি ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তারা এটির নামকরণ করেছেন ‘প্রপাগান্ডা মডেল’।

হিরো আলম লুটেরা শাসকগোষ্ঠী আর তার সেবাদানকারী এই সমস্ত মিডিয়ার সৃষ্ট ‘প্রপাগান্ডার’ একটি প্রডাক্ট মাত্র। যে প্রডাক্টকে বেচা-বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেওয়া যায়! এতে গনমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে বিন্দুমাত্র কোন প্রভাব ফেলেনা।
সে তার নিজের স্বার্থেই মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ করবে; প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম দলে যোগ দিবে। সেটা সে তার প্রয়োজনেই করবে, তার স্বার্থ যেখানে হাসিল হবে সেখানেই যাবে। আর লুটেরা মিডিয়া যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে নিয়ে বাণিজ্য করতে পারবে সেই সময় পর্যন্ত তাকে নিয়ে খবর করবে, মাতিয়ে রাখবে। আমরাও তিন নাম্বার ছাগলের বাচ্চার মতো মেতে থাকবো।

তাতে এদেশের গনমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে কোন প্রভাব তৈরি করবেনা; বরং সেই লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি যে, আমরা আমাদের মুক্তির প্রশ্নে এভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে থাকছি। শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠীকে গালাগালি করলেই মুক্তির পথ আপনাতেই তৈরি হয়ে যায় না; তারজন্য শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার আলোকে সংগ্রাম সংগঠিত করাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়!

শেয়ার করুন