ডেস্ক রিপোর্ট
২২ মে ২০২৩, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ
আবু নাসের অনীক::
আগামী মে-জুন-জুলাই মাসে দেশের ৫টি সিটি কর্পোরেশন ও ৫ টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বৃহত্তম দুইটি রাজনৈতিক দল কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের অস্থায়ী-স্থায়ীভাবে বহিস্কার করছে।
উভয় দলের ক্ষেত্রে এই বহিস্কারের কারণ দলীয় শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। অবশ্য এই চিত্রটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার এমনটি ঘটেছে। বর্তমান সময়ে এর প্রকোপ বেড়েছে; ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে।
আমি আলোচনাটি করতে চাই কেন এমনটি ঘটে। এমনটি ঘটার প্রধান যেটি কারণ সেটি হচ্ছে,এই রাজনৈতিক দলগুলির সাথে যারা সম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতি করেন তাদের অধিকাংশই কোন ধরনের মতাদর্শ ধারন করে রাজনীতিটা করেন না। রাজনৈতিক দলগুলি কার্যকর অর্থে তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আদর্শ সঞ্চারিত করতে ব্যর্থ।
অর্থাত এই রাজনৈতিক দলগুলি পরিচালনার ভিত্তি কাঠামো কোনভাবেই আদর্শভিত্তিক নয়। বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক দলের জন্ম ও বিকাশ ঘটে তার পক্ষে আদর্শবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয় না।
শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই লুটপাটের সাথে সম্পৃক্ত হয়। রাজনৈতিক দলগুলি হয়ে ওঠে এই লুটপাটকারীদের আশ্রয়স্থল। প্রথম দিকে আদর্শবাদীতার কিছু চর্চা থাকলেও লুটপাট রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথেই আদর্শবাদীতা কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
ক্রমেই এই ধারা প্রান্তিক হয়ে ওঠে। যার কারণে ক্ষমতা বলয়কে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রত্যেক স্তরে উপদল সৃষ্টি হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল যখন যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে সেই রাজনৈতিক দলের মধ্যে তাদের উপদলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল উপদল-গ্রুপিং সৃষ্টির ব্যাখ্যা হিসাবে বলে থাকে, একটি বড় রাজনৈতিক দলে অনেক ধরনের মত থাকে, প্রতিযোগিতা থাকে এজন্য এমনটি হয়। সেটি হতেই পারে! অনেক মত যেখানে থাকবে সেখানে মতাদর্শ চর্চা আরো বেশি হওয়ার কথা!
কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? বাস্তবতা হচ্ছে, একই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা পরস্পর পরস্পরের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এক অপরকে হত্যা করতে কুন্ঠাবোধ করছেনা।
সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩ স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬ জন নিহত এবং এক হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছেন। এসব সহিংসতার বেশিরভাগই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে সংগঠিত হয়েছে। যার সংখ্যা ৪৬ টি।
এ ছাড়া গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৪ মে ২০২৩ পর্যন্ত এই ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাতে ছয়জন নিহত হয়েছে। এই সংঘাত আর হত্যাকান্ডগুলি এরা জায়েজ করার চেষ্টা করে থাকে মতাদর্শিক ভিন্নতা আর প্রতিযোগিতার বাতাবরণে।
প্রকৃতপক্ষে এটা ব্যক্তির একে অপরের ক্ষমতা-আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে রক্তপাত হবে, হত্যাকান্ড ঘটবে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। বরং এর সাথে মতাদর্শিক ভিন্নতা যুক্ত করা খুবই অস্বাভাবিক! শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য এই সবকিছুকেই বৈধতা দিয়ে থাকে। কারণ এদের শ্রেণী বৈশিষ্ট্যই লুটেরা প্রকৃতির।
ঠিক এসব কারণেই যখন কোন নির্বাচন আসে তখনই এই দলগুলিতে এ ধরণের অস্থিরতা বেশি দেখা দেয়। একটি আদর্শ রাজনৈতিক দলের প্রথমত শর্ত থাকে শৃঙ্খলা। এই অভাবটাই এখানে প্রকট।
দলীয় গঠণতন্ত্রের দোহায় দিয়ে, যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেয়ে নির্বাচন করে তাদের বহিস্কার করা হয়। কিন্তু কিছুকাল পরেই আবার সাধারণ ক্ষমার নামে তাদেরকে আবারো দলে ফিরিয়ে আনা হয়।
বলা যায়, ফিরিয়ে আনতে তারা বাধ্য হয়। কারণ এই সকল অংশ ছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়া এই সমস্ত বহিস্কারের কোন নৈতিক ভিত্তি থাকেনা আদৌ। কারণ অনেক সময় দেখা যায় ঐ বহিস্কৃতরাই বিজয়ী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আসে।
এই ঘটনাটি কেন ঘটে? ঘটে তাদের মনোয়ন বাণিজ্যের কারণে। অর্থের বিনিময়ে প্রভাবিত হয়ে মনোয়ন প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রার্থীর পরাজয় ঘটে নানা কারণে। সেকারণেই বহিস্কৃতদের দলে ফিরিয়ে নিতে তারা বাধ্য হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ, নির্বাচন করার জন্য নেতা কর্মীরা এতো মরিয়া হয়ে ওঠে কেন? কারণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া আর নতুন একটি ব্যবসার মালিক হওয়া সমার্থক একটি বিষয় তাদের কাছে। এবং এই নতুন ব্যবসা অন্য আর দশটি ব্যবসার চাইতে অনেক বেশি লাভজনক।
একদিকে প্রশাসনিক ক্ষমতা চর্চা করার একটি ক্ষেত্র তৈরি হওয়া অন্যদিকে একইসাথে বেসুমার অর্থ লোপাটের সুযোগ তৈরি হওয়া। যার জন্য নির্বাচনে একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকে অবস্থা ভেদে।
শুধুমাত্র জনসেবা করার জন্য কোন আকাট মূর্খেরেও কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা না। যারা বিনিয়োগ করে এটা নিশ্চিত হয়েই করে যে নির্বাচিত হতে পারলে ঐ পদকে ব্যবহার করে যা বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার চেয়েও আরো কয়েক গুণ বেশি ফেরত আনা সম্ভব হবে।
সাথে বাড়তি পাওনা হিসাবে থাকছে সামাজিক স্বীকৃতি, আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি হওয়া, জনপ্রতিনিধি হিসাবে নিজেকে জাহির করার সূবর্ণ সুযোগ! এই সবকিছুর সাথে আদর্শবাদীতার বিন্দুমাত্র কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্কটি লুটপাটের সাথে সম্পৃক্ত।
অর্থাত এই বিষয়টি পরিস্কার যে,লুটেরা ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আদর্শের বিন্দুমাত্র কোন সম্পর্ক নেই। পুরো রাজনীতিটাই ক্ষমতাতন্ত্র-লুটপাটতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এধরণের আদর্শহীন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয় তার সংবিধান-আইন-কানুন কোন কিছুই জনগণের পক্ষে ভূমিকা রাখেনা।
একটি দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয় থাকে। তারমধ্যে একটি শক্তিশালী,স্বাধীন নিরেপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নিরেপেক্ষ বিচার বিভাগ, নিরেপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর কোনটাই এখানে গত ৫৩ বছরে গড়ে ওঠেনি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিলো সেই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির যারা গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশকে পরিচালনা করেছে। প্রকৃতঅর্থে এই সকল একটি রাজনৈতিক দলও তাদের নিজেদের দলের মধ্যেই কোন ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা করেনি।
এখানে সর্বত্রই ব্যক্তির প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ’৭২ সালের যে সংবিধানটি রচনা করা হয়েছিলো সেটি একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রচনা করা হয়েছিলো! আমাদের দেশের যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তারা তাদের নিজেদের কোন সংবিধান ভাবনা না ভেবে এই সংবিধানটিকেই আদর্শ সংবিধান হিসাবে প্রচার করে থাকেন।
কেন করেন? কারণ এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। তাদের কাছেও ব্যক্তিকেন্দ্রীক ’৭২ সালের এই সংবিধান আদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়। তার কারণেই বর্তমান এই আদর্শহীন রাজনীতির স্রোতের বিপরিতে তারা আদর্শবাদী রাজনীতির কথা বল্লেও সে রাজনীতি জনগণের মধ্যে কোন প্রভাব তৈরি করছেনা!
জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠা পর্যন্ত আমাদের মুক্তি নেই। জনগণের ঐক্যবদ্ধতাই পারে সেধরণের একটি ইতিবাচক শক্তির বিকাশ ঘটাতে।