ডেস্ক রিপোর্ট

৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

অনিবার্য সংঘর্ষ আর অনর্থক সংলাপ

আপডেট টাইম : নভেম্বর ৫, ২০২৩ ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

রাজেকুজ্জামান রতন:

এতদিনের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ আর জমায়েতের পর কি সংঘর্ষের পথে রাজনীতি চলতে শুরু করল? এ ধরনের আশঙ্কা ছিল আগে থেকেই, কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর সেটা যেন অনিবার্য হয়ে উঠল। বাংলাদেশের রাজনীতি যে আবার সংঘর্ষের পথেই ফিরে এলো, তার পথ তৈরি হয়েছে ২৮ অক্টোবর থেকে। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এটা হলো? গত পাঁচ বছর ধরে বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নিয়ে নানা বিদ্রুপ করা হলেও সংঘাতের ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। দু-একটি ঘটনা ছাড়া সমাবেশগুলো আপাত শান্তিপূর্ণ হওয়ায় সমাবেশে অংশগ্রহণও বাড়ছিল। যারা সংঘাত চলুক এমন চিন্তা করেন, তাদের মধ্যে কি এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের দাবি আরও প্রবল হয়ে উঠবে? নির্বাচনের আগে ভেতরে-বাইরের চাপ এবং জনসমর্থনের কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো আপস সমঝোতার পথে অগ্রসর হতো। সংঘাত, মামলা, গ্রেপ্তার সম্ভবত সেই পথ বন্ধ করে দিল।

২৮ অক্টোবরের আগে এবং পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক থাকল না। যেমন থাকেনি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে।

বিরোধী দলের হরতাল অবরোধ এবং তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নেতাদের বিরুদ্ধে মৃতপ্রায় মামলা সজীব হয়ে ওঠা এবং বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া পরিস্থিতিকে আপাত জটিল এবং সরকারের অনুকূলে নিয়ে এসেছে। গণহারে মামলা এবং আটক করা দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, ক্ষমতাসীন দল এ অবস্থা অব্যাহত রেখেই একটি সাজানো নির্বাচন করতে আগ্রহী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য এবং পুলিশের আচরণ থেকে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে তারা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হোক এটা চায় যাতে বিরোধীরা শুধু নিপীড়নের শিকার হবে তাই নয়, কর্মীদের ক্ষোভ এমন মাত্রায় বাড়বে যে তাদের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না অথবা এমন মামলা-হামলা চলবে যে তারা অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা কম নয়, নির্বাচন এলে তার তীব্রতা বাড়ে। ফলে বিরোধী দল অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হবে এটা একরকম অবধারিত। কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। বিগত নির্বাচনগুলোর কারণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন জনগণের সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি কি শুধু বিরোধী দলের দাবি? তা নয়। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে যে দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ মনে করে যে বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। একথা শুধু জরিপে নয় সাধারণ মানুষ এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও যদি একটু ভেবেচিন্তে কথা বলেন এবং তারা যদি বিরোধী দলের অবস্থানে নিজেদের ভাবেন তাহলে বলবেন, না দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না। সে কারণেই ক্ষমতাসীনরা আলোচনার টেবিলে বসতে অনাগ্রহী। এ রকম পরিস্থিতিতে বিরোধীদের জন্য করণীয় কী? সরকারের প্রবল কর্র্তৃত্ব মেনে নিয়ে নির্বাচনে তারা কি তাদের কাক্সিক্ষত ফল লাভ করতে পারবে? নিশ্চয়ই নয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের মেয়াদ বর্ধিতকরণের প্রক্রিয়ার আইনসংগত ভিত্তি দেওয়ার কাজ কি তারা করবে?

এদিকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শেষবারের মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে। এ লক্ষ্যে আজ নিবন্ধিত ৪৪টি দলকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সকালে ২২টি ও বিকেলে ২২টি দলকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দলগুলোর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিরা সংলাপে আমন্ত্রিত।

আমন্ত্রিত দলগুলো আলাদা হলেও নির্বাচন কমিশন দলগুলোকে যে চিঠি দিয়েছে, তার ভাষা একই। চিঠিতে ইসি বলেছে, সংসদের মেয়াদপূর্তির কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩১ অক্টোবর থেকে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে কারণেই নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতির অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। কিন্তু তাদের চিঠি প্রমাণ করে এটা কোনো সংলাপের আয়োজন নয়, অবহিতকরণ সভা। একথা আরও স্পষ্ট করেছেন ইসি সচিব। তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে ইসি যেসব কার্যক্রম নিয়েছে, তা রাজনৈতিক দলগুলোকে অবহিত করা হবে এবং তাদের কোনো পরামর্শ থাকলে সেটা শুনবে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশন তাদের প্রস্তুতি জানাবেন, পরামর্শ শুনবেন সেটা ভালো কথা। কিন্তু কাদের সঙ্গে? আন্দোলনরত বিএনপির নেতারা কারাগার ও আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায় তারা যদি বলেন, তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধি নেই, তাহলে কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইল কমিশনের সচিব বলেছেন, ‘নো কমেন্টস (মন্তব্য নেই)।’ আর নির্বাচন নির্ধারিত সময় ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের হাতে অন্য কোনো অপশন নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বরাবরই ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তাদের ডেকে আনা বা সুযোগ দেওয়ার কারণে হস্তক্ষেপ আরও বেড়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার একটি ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের সমাবেশ বিরুদ্ধে অভিযানের যৌক্তিকতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেই ব্যাখ্যার পর রাষ্ট্রদূতদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এতে অনুমান করা যায়, রাষ্ট্রদূতদের অবস্থানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি। নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে কিছু কথা উঠেছে, এমন মন্তব্য করে সিইসি বলেছেন, তারা সব সময় চান নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ হোক। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ হলে নির্বাচন হবে না, এমন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং যেন জনগণের মধ্যে না থাকে। অন্যদিকে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কোনো হয়রানি, নির্বিচার গ্রেপ্তার বা সহিংসতা দেখতে চায় না জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক।

এসব তো গেল বিদেশিদের পরামর্শের ব্যাপার। বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে চারটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমটি হলো, নির্বাচনের আগের পরিবেশ। নির্বাচনপূর্ব সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত হলো প্রতিপক্ষকে দৌড়ের ওপর রাখা। এ ব্যাপারে ফৌজদারি মামলার ব্যবহার মামলা, গ্রেপ্তার ইত্যাদি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান অস্ত্র। লাখ লাখ মামলার ভারের নিচে দাঁড়িয়েই শাসক দলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজনীতি করতে হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার ক্ষেত্রে এই কৌশলের জনপ্রিয় নাম হচ্ছে ‘গায়েবি মামলা’। মামলা গায়েবি হলেও আসামি কিন্তু বাস্তবে জেল অথবা জামিনে থাকছে। বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দেওয়ার জন্য ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি নামে নতুন এক কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে। গায়েবি মামলা আর অজ্ঞাতনামা আসামির দুর্বিষহ ভার তাদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। আর ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য এদের বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ দেওয়া নয়, বরং ‘অভিযুক্ত’দের দৌড়ের ওপর রাখা।

নির্বাচনপূর্ব আর একটি পরিস্থিতি হলো, রাজপথের সংঘাত। সহিংসতা এড়ানোর বিষয়টি শুধু বিরোধী দলের একার ওপর নির্ভর করে না। যদিও এতদিন ধরে বিরোধীরা তাদের কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পেরেছিল। কিন্তু পুলিশের কঠোর অ্যাকশন এবং বিরোধীদের হরতাল অবরোধ কর্মসূচি ফেরত আসা প্রাক-নির্বাচনী সময়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অবসান ঘটল।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় এবং নির্বাচনের দিনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নজরদারি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় দেখা যায়। যেমন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ভোটকেন্দ্রগুলোর প্রিসাইডিং অফিসার নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ইসির নিজস্ব ক্ষমতাকে নির্বাহী বিভাগের কাছে সমর্পণ করা। এ বিষয় পরিষ্কার যে প্রশাসন ও শাসক দলের মধ্যকার নাড়ির বন্ধন এতই শক্তিশালী যে এই প্রশাসন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কঠিন। ইসি যদি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে হবে।

আর একটি বিষয় হলো, নির্বাচনের দিন গুরুতর অনিয়ম ঘটার পরও নির্বাচন কমিশনের ‘কিছুই না দেখা-কিছুই না করা’র প্রবণতা। প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারা, বুথের ভেতর ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, ভোটকেন্দ্রের বাইরেও ভোটারদের হুমকি দেওয়া, নির্বাচনের আগের দিন ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আসতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি সবাই দেখলেও নির্বাচন কমিশনের চোখে পড়ে না। ভোট দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর ভোট গণনা এবং ফল প্রকাশ নিয়েও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। বিগত নির্বাচনে এই তিক্ত সত্য জনগণ দেখেছে। বিভিন্নভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছামতো প্রচারণা চালানোর প্রবণতা নতুন নয়।

এসব বহাল রেখে আগামী নির্বাচন কি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে? নাকি একতরফা হবে? বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাগুলো একথা নিশ্চিত করছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ নিশ্চিত নয়, সহজও নয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, প্রশাসনিক কর্র্তৃত্বের হাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ, ফৌজদারি মামলাকে হাতিয়ার বানিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমন এগুলোই নির্বাচনকালের নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে যৌক্তিক করে তুলেছে। এই দাবি পূরণ নির্বাচনের আস্থা সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারত এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। কিন্তু ২৮ অক্টোবর ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি রাজনৈতিক পরিবেশকে গণতন্ত্রায়নের পরিবর্তে উল্টো দিকেই কি ধাবিত করছে না?

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন